Adsterra

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ : পর্ব- ২। জেরুজালেম কেন সব ধর্মালম্বীদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ ?

ইসরাইল ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব, পর্ব ২, ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে কিভাবে গড়ে উঠে ইসরাইল রাষ্ট্র, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, today top news, today trending

পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র নগরী হিসেবে পরিচিত জেরুজালেম। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর শহর এটি। ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় নাম লেখানো ওল্ডস সিটি নামক খ্যাত নগরীটিতে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও আর্মেনিয়দের বসবাস। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের অনেক পবিত্র স্থাপনা। নগরীর পবিত্রতা নিয়ে মতভেদ না থাকলেও নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আছে নানা বিতর্ক, আছে দখল, পুনঃদখল, ধ্বংস আর পুনঃনির্মাণের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। মুসলিমদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে এখানে। একই জায়গাত অবস্থিত ইহুদিদের পবিত্র ভূমি ক্ষ্যাত টেম্পল মাউথ বা ঈশ্বরের ঘর। তাই ছোট্ট এই শহরটিকে ঘিরে রয়েছে মুসলমান, ইহুদি,খ্রিস্টান তিন ধর্মের মানুষেরই আবেগ আর স্মৃতি । কেন তিন ধর্মের কাছে জেরুজাল এত গুরুত্বপূর্ণ।

জেরুজালেম মুসলিমদের কাছে " আল-কুদস" যার অর্থ পবিত্র স্থান। এই নামে পরিচিত। খ্রিস্টানদের কাছে "জেরুজালেম "আর ইহুদিদের কাছে "ইরুশালাইম" হিসেবে পরিচিত।ইতিহাসবিদদের মতে জেরুজালেমের প্রথম মানব বসবাসতি শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্রোঞ্জ যুগে।

আরও বলা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালে রাজা ডেভিট জেরুজালেম জয় করেন এবং এটিকে ইহুদি রাজ্যের রাজধানী করেন। প্রথম পবিত্র মন্দিরটি রাজা ডেভিট এর জেরুজালেম দখলের প্রায় ৪০ বছর পর তার পুত্র সলেমন তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। ৫৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয়রা জেরুজালেম দখলের পর তারা মন্দিরটি ধ্বংস করে তারা ইহুদিদের নির্বাসনে পাঠায়। এর পর প্রায় ৫০ বছর পর পারস্যের রাজা সাইরাস, ইহুদিদের জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার পাশাপাশি মন্দির পুনঃনির্মাণের অনুমতি দেন। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট জেরুজালেমে নিয়ন্ত্রণ নেন। পরবর্তীতে রোমান, পার্সিয়ান, মুসলমানরা সহ আরো অনেকেই শহরটি শাসন করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা নিজেরাই এই ভূমি দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল স্বাধীন রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশরা জেরুজালেম ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে।

ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ 'আল আকসা ' বা 'বায়তুল মুকাদ্দাস' জেরুজালেমে অবস্থিত। সৌদি আরবের মক্কার ' মসজিদুল হারাম' ও মদিনার 'মসজিদে নাবাবির' পরেই মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্র স্থান এই আল আকসা মসজিদ। ইতিহাসবিদদের মতে, বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা ইসরাইল-ফিলিস্তিনদের মূলে রয়েছে এই পবিত্র মসজিদ। কেননা মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদী ও খ্রিস্টানরাও এটিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে। ইতিহাসের হাজার ও ঘটনার সাক্ষী এই মসজিদ। "মসজিদুল আকসা "অর্থ দূরবর্তী মসজিদ।

বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত অনুসারে, আল আকসা প্রথম নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে। 'বায়তুল মুকাদ্দাস' এর প্রতিষ্ঠাতা হয় হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বারা। পবিত্র কাবা নির্মাণে ৪০ বছর অতিক্রম হবার পর।তার নাতি বনি ইসরাইলের প্রথম নবী হযরত ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেরুজালেমে 'আল আকসা 'মসজিদ নির্মাণ করে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০৪ সালে মসজিদটির পুনঃনির্মাণ করেন হযরত সুলাইমান (আ.)। এরপর বিভিন্ন সময় এর সংস্কার করা হয়। মসজিদটি ৩৫ একর জমির উপর নির্মিত এর। ২ টি বড় ও ৩৬ টি গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটতে প্রকাশ পেয়েছে নির্মাণ শৈলীর এক মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি। বিভিন্ন সময়ে মসজিদটজ সংস্কারে ব্যবহার করা হয় মার্বেল, স্বর্ণ সহ নানা ধরনের মূল্যবান ধাতু ও পাথর। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মসজিদের সমন্বয়ে গঠিত পুরো মসজিদের চত্ত্বটি। মসজিদে কিবলি, মসজিদে মারওয়ানী, মাসজিদুল করিম, মাসজিদুল বোরাক,তুবতুস সাকলাম এই পাঁচটি মসজিদে সমন্বয়ে পুরো চত্ত্বর।

আল আকসায় প্রবেশ এবং বাইরে যাওয়ার জন্য ১০ টি দরজা খোলা রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি মুসলমানরা ব্যবহার করতে পারে। ব্যতিক্রম হলো মরক্কান গেট। যেটি শুধুমাত্র অমুসলিমদের প্রবেশের জন্য ব্যবহার করা হয়।

বলা হয়ে থাকে, বায়তুল মোকাদ্দাস মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গমনস্থল ও ইসলামী রাজের স্থান। নবীজি স্বশরীরে স্বজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হযরত জিব্রাইল ( আ.) ও হযরত মিকাইল (আ.) এর সঙ্গে বোরাকে চড়ে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সাত আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে একাকি রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত যান। এরপর মহান রাব্বুল আলামিন সঙ্গে তার দিদার লাভ ও সংলাপের পর জান্নাত, জাহান্নাম পরিদর্শন করে তিনি ফিরে আসেন। নবীজির এই যাত্রা থেকে শুরু করে ফিরে আসা ইসলামি পরিভাষায় পুরো প্রক্রিয়াই হলো ' মিরাজ' আর মিরাজের প্রথম অংশ কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ হলো' ইসরা' ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ।নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজে যাওয়ার আগে সব নবীদের নিয়ে যেখানে নামাজ পড়েছিলেন সেই স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আর সেটি হল কিবলি মসজিদ। বায়তুল মোকাদ্দাসকে ঘিরে আছে একটি ১৬৯ ফিটের দেয়াল, যেটি বুরাক ওয়াল বা পশ্চিম দেয়াল নামে পরিচিত। এর উচ্চতা ৬০ ফুট।

এই বুরাক ওয়াল এর কোনো এক জায়গায় বুরাককে বেঁধে রেখে নামাজ পড়েছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) সেই প্রাচীরের উল্টো দিকেই বুরাক মসজিদ। আর পুরো চত্ত্বরেই সোনালী গম্বুজের সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনাটির নাম 'ডোম অফ দ্যা রক' বা 'কুববাতুস শাখারা' যেখানে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে শীষ নবী উদ্ধা আকাশে গমন করেছিলেন। কথিত আছে, ৬৯১ সালে খলিফা আব্দুল মালেক, ইবনে মারওয়ান এটি নির্মাণ কাজ শেষ করেন। ইসলামের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা নির্দেশন এটি। বায়তুল মুকাদ্দাস এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা হিসেবে পরিচিত। এর গায়ে আরবিতে লেখা সুরা ইয়াসিনইসলামবিদদের মতে, আল আকসা মসজিদ ছিল মুসলমানদের প্রথম কেবলা। পরে মক্কার দিকে মুসলমানদের কেবলা ঘুরে দেয়। তাই মুসলমানদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই মসজিদ।

মুসলমানদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল এখানেই। মুসলমানদের আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) জেরুজালেমের 'মাউন্ট মরিয়া 'পাহাড়ে তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইলকে কোরবানি দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া আরও বেশ কিছু কারণে আল আকসা মসজিদ মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে প্রথম নির্মিত মসজিদ 'মসজিদুল হারাম ' হলেও এরপরে রয়েছে জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ 'মসজিদে আকসা 'এই জায়গাটি অসংখ্য নবী রাসূলের স্মৃতি বিজড়িত। এর চত্ত্বরে অসংখ্য নবী রাসুলের সমাধি রয়েছে। অনেক সাহাবাকেও এখানে সমাধিত করা হয়েছে। বলা হয়ে কোরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৭০ বার এই আল আকসা মসজিদের নাম উল্লেখ রয়েছেএটি একমাত্র মসজিদ কাবার পরে যার নাম কোরআনে বলা হয়েছে।

ইহুদিদের কাছে এটি 'টেম্পল মাউন্ট' নামে পরিচিতি। এটিকে ঘিরে থাকা 'ওয়েস্টার্ন ওয়াল' বা যেটা মুসলমানদের কাছে ' বুরাক ওয়াল' হিসেবে পরিচিত। ইহুদিদের কাছে তা পৃথিবীর ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে স্বীকৃত। ইহুদিরা মনে করেন, এই স্থানেই ছিল তাদের ফার্স্ট এবং সেকেন্ড টেম্পল। যা রোমানরা এসে ধ্বংস করে দেয় ৭০ খ্রিষ্টাব্দে। ইহুদিরা মনে করে এটি তাদের বিশ্বের সবথেকে পবিত্র স্থান যেখানে উপাসনায় লাখো ইহুদি।

খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে ও পবিত্রতা দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গা। 'বায়তুল মুকাদ্দাস' এর বাইরে পূর্ব পাশে আছে 'ওমর মসজিদ ' ও খ্রিস্টানদের পবিত্র গির্জা 'সেপাল জায়'এখানেই যীশুকে ক্রুশবিদ্ধকরণ করা হয়েছিল এবং এখান থেকেই তার পুনর্জন্ম হয়েছিল বলে তাদের বিশ্বাস।

জেরুজালেমের 'ওল্ড সিটি' বিশাল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে প্রবেশের জন্য মোট ৮ টি দরজা রয়েছে। পূর্ব দিক থেকে ঢোকার একমাত্র গেটটি 'গোল্ডেন গেট' নামে পরিচিত। গেটটি বহু বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মবলম্বীদের মতে এই গেট দিয়ে দ্বিতীয়বার যীশু ভেতরে প্রবেশ করবেন।

No comments

Powered by Blogger.