Adsterra

মার্কিন দেশকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং

মার্কিন দেশকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, today top news, today trending news, hot news, update news, somoy news,


বলা হয়ে থাকে যে, জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকাকে স্বাধীন করেছেন, আব্রাহাম লিংকন এনেছেন গণতন্ত্র, তবে মার্কিন দেশকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং। তাঁর নেতৃত্বে কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান অধিকার, আর সাদা নাগরিকেরা পেয়েছে বর্ণবাদের অভিশপ্ত অহংকার থেকে মুক্তি। তিনি ছাড়া আমেরিকার বড় অংশ সাবেক বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার দশায় পড়ে থাকত। 


যে দেশে একসময় কালো শিশুরা সাদা শিশুদের সঙ্গে পড়তে পারত না, যেখানে সাদা যাত্রীকে দেখে বাসের আসন ছেড়ে দিতে হতো কোনো কালো মহিলাকে, কোনো শ্বেতাঙ্গিনীকে ভালোবাসার অপরাধে যে দেশে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে কেটে কুটিকুটি করা হতো, মার্টিন লুথারের নাগরিক স্বাধীনতা আন্দোলনের জের ধরে আজ সেই দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা। মার্টিন লুথারের মাধ্যমেই আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী ২০০ বছরের লড়াই পরিণতি পায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার জর্জিয়ায় ১৫ই জানুয়ারি, ১৯২৯ জন্ম গ্রহণ করেন। 


তার বাবার নাম মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র এবং মা আলবার্ট উইলিয়ামস কিং। তিনি ছিলেন একাধারে আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মন্ত্রী,মানবাধিকার কর্মীএ,বং আফ্রিকান-আমেরিকান সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এর নেতা। তিনি তার খৃস্টান বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্য বেশি পরিচিত। তিনি ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি হতে আমৃত্যু আমেরিকার সিভিল রাইট মুভমেন্ট এর নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। 


মার্টিন লুথার কিং যে কোন এলেবেলে ধরনের ছেলে ছিলেন না, তা তাঁর কিশোর বয়স থেকেই বুঝা গিয়েছিল। তার যখন ৬ বছর বয়স তখন মার্টিন লুথার কিং এর সাথে এক সাদা বালকের বন্ধুত্ব হয় যার বাবা ছিল একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হবার পর তার বাবা আর তাকে কিং এর সাথে মিশতে দেয়নি। এজন্য কিং মানসিকভাবে খুবই হতাশ ছিলেন। আটলান্টার বুকার টি ওয়াশিংটন হাইস্কুলে তার স্কুল জীবন শুরু। 


কালো চামড়ার ছিলেন বলে তাকে কালোদের জন্য নির্দিষ্ট স্কুলে তাকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে তাকে ক্লাস নাইন ও ক্লাস টুয়েলভ পড়তেই হয়নি। দুইবার অটো-প্রমোশন পেয়ে ১৯৪৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মোর-হাউজ কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান এর উপর স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে দর্শন শাস্ত্রে পিএইচডি, ডক্টর অব ফিলোসোফি ডিগ্রি লাভ করেন। এতক্ষণ যা বললাম তা কম বেশী প্রায় সবই আমাদের জানা। আমি আজকে মার্টিন লুথার কিং সম্পর্কে এমন কিছু বিষয় নিয়ে বলবো যা হয়ত অনেকেই জানেন না। যেমন অনেক মানুষ মনে করে মার্টিন লুথার আর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র হয়ত এক ই ব্যক্তি। 


কিন্তু আসলে এঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন ইতিহাসের দুইজন মানুষ। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক দুইজন বিখ্যাত মানুষের নামের এত মিলের পিছনের রহস্য। মার্টিন লুথার কিং এর নাম কিন্তু আসলে মাইকেল কিং ছিল, মার্টিন লুথার কিং না। মার্টিন লুথার কিং এর বাবা মাইকেল কিং সিনিয়র যিনি একজন ধর্মযাজক ছিলেন, তিনি ১৯৩১ সালে জার্মানি তে ভ্রমন করার সময় বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক মার্টিন লুথার এর স¤পর্কে জানতে পারেন এবং তাঁর ধর্মবিপ্লবের ইতিহাস জেনে এতই অভিভূত হন যে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিজের নাম এবং নিজের ৫ বছর বয়সী ছেলের নাম মাইকেল পরিবর্তন করে নাম রাখেন মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। 


আমেরিকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষ দের স্বপ্ন দেখেনো মার্টিন লুথার কিংও কিন্তু নিজেই কিশোর বয়সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৪১ সালে ১২ বছর বয়সী কিং বাবা মার কথা অমান্য করে একদিন প্যারেড দেখতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরে এসে দেখেন তাঁর দাদি হার্ট এটাক এ মারা গেছেন তখন তিনি তাদের দোতলার জানালা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ১৯৫৪ সালে কিং ডেক্সটার এভিনিউ ব্যাপটিস্ট চার্চে যাজক হিসেবে যোগদান করেন, তবে মজার বিষয় হল কিং কিন্তু প্রথম জীবনে যাজক হতে চাননি, বরং হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার বা উকিল।যদিও ডাক্তার বা উকিল কোনটাই তাঁর আর হওয়া হইনি। 


১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি, চাকরির সমতা অর্জন এবং সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লুথার কিং, বেয়ারড রাস্তিন এবং আরও ছয়টি সংগঠনের সহায়তায় মার্চ অন ওয়াশিংটন ফর জব এন্ড ফ্রিডম (March On Washington for Job and Freedom.) নামে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশটি ছিলো আমেরিকার ইতিহাসে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ মহা-সমাবেশ। এই সমাবেশে যোগ দেবার জন্য অসংখ্য মানুষ ২০০০ টি বাস, ২১ টি স্পেশাল ট্রেন, ১০ টি এয়ারলাইন্স এর সকল ফ্লাইট ও অসংখ্য গাড়িতে করে ওয়াশিংটনে এসেছিল। সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল লিঙ্কন মেমোরিয়ালে। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল ঐ মহা-সমাবেশে।


“I Have a Dream”(‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’) নামে লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়া সেই বিখ্যাত ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাগ্মিতার দৃষ্টান্তগুলোর অন্যতম হয়ে আছে। ১৯৬৪ সালের ১৪ ই অক্টোবর তিনি তাঁর অহিংস আন্দোলনের জন্য, বিশ্ব শান্তি রক্ষায়, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন তিনি ।নোবেল পুরস্কার ছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার লাভ করেন। তবে মজার বিষয় হল তিনি কোন সঙ্গীত শিল্পী না হয়েও বেস্ট স্পোকেন ওয়ার্ড এ্যালবাম ক্যাটাগরিতে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন । ১৯৭১ সালে তাঁকে এই মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হয়েছিল তাঁর “Why I Oppose the War in Vietnam“ এ্যালবাম এর জন্যে। 


মার্টিন লুথার কিং ছাড়া আর মাত্র দুইজন ব্যক্তির সম্মানে আমেরিকায় জাতীয় ছুটি পালন করা হয়ে থাকে। সেই দুইজন হলেন জর্জ ওয়াশিংটন এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাস। মজার বিষয় হল এদের মাঝে একমাত্র কিং ই আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি যার সম্মানে আমেরিকায় জাতীয় ছুটি পালন করা হয়। আমেরিকার বাইরেও টরন্টো, কানাডা এবং হিরশিমাতে , জাপান মার্টিন লুথার কিং দিবস পালন করা হয়। শুধু দিবসই না , মার্টিন লুথার কিং এর নামে পুরো আমেরিকায় প্রায় ৭০০ টি রাস্তার নামকরন করা হয়েছে।এ ছাড়া অনেক স্কুল, বিল্ডিং এর নাম ত রয়েছেই তাঁর নামে। 


১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় কিং মেম্ফিসের একটি মোটেলের ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে তিনি গিয়েছিলেন মূলত আবর্জনা সংগ্রহকারীদের আন্দোলনের সাথে একমত প্রকাশ করতে। ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং হাসপাতালে নেয়ার অল্প কিছুক্ষণ পরই ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ১৯৬৮ সালের ৮ জুনে হিথ্রু এয়ারপোর্ট থেকে জন আর্ল রে নামে এক ব্যক্তি কে কিং এর হত্যাকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। জন আর্ল রে মিসৌরি স্টেট কারাগারের একজন পলাতক আসামী বলে যান যায়। ঐ সময় জন হত্যার সকল দায়ভার স্বীকার করে নেয়। তখন তাকে ৯৯ বছরের জেল দেয়া হয় শাস্তিস্বরূপ। 


কিন্তু পরবর্তীতে জন আর্ল রে অনেকবার নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। তবে আততায়ীর হাতে মৃত্যুর ও এক দশক আগে আর একবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল কিং কে ।১৯৫৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি যখন হারলেম শহরে একটি ডিপারটমেণ্টাল দোকানে গিয়েছিলেন তাঁর বই “stride toward freedom” স্বাক্ষর করতে তখন ইজুলা ওয়ার কারি নামে এক মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করে তাঁর নাম মার্টিন লুথার কিং কিনা। তিনি হ্যাঁ বলার পর ই মহিলা একটি ৭ ইঞ্চি লম্বা ধারালো ব্লেড দিয়ে তাঁর বুকে আঘাত করে।যার ফলে তাঁকে জরুরী অস্ত্রোপাচার করাতে হয়েছিল। ফলে একটা লম্বা সময় ধরে হাসপাতালে থাকার পর কিং তাঁর উপর হামলাকারী মানসিক বিকারগ্রস্থ মহিলার প্রতি কোন বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন নি। 


মার্টিন লুথার কিং এক কিংবদন্তী নেতার নাম,তাঁর কর্ম দিয়ে তিনি এত বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাঁর পিছনে গোয়েন্দা নিয়োগ করেছিল বলেও নাকি জানা যায়।তাই কিং এর মৃত্যুর পিছনে ষড়যন্ত্র নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের যে দাবি তা একদম অমূলক ও বলা যায়না। মানব কল্যাণে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং। তবে নোবেল নয়, মনে-প্রাণে সবসময় মানবতার বিজয় কামনা করেছিলেন তিনি। "

No comments

Powered by Blogger.