সাপলেজা নাম করণের ইতিহাস
ভারত উপমহাদেশে মুঘলদের শাসনামল থেকে ব্রিটিশদের শাসনামল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা চালু ছিল, যা তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ
"চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত"
নামে ১৭৯৩ সালে জায়গিরদারি প্রথা বিলুপ্ত করে জমিদারী প্রথা চালু করেন। যার ফলে এটি
"জায়গিরদারি"
প্রথা থেকে
"জমিদারী"
প্রথায় রূপ নেয়। জমিদারি প্রথার ফলে বাংলায় বুর্জোয়া শ্রেনী তৈরি হয়। এক শ্রেনী অন্য শ্রেনীর প্রভূতে রুপান্তরীত হয়। জমিদাররা অধিকাংশ সময় কৃষকের থেকে বেশি খাজনা আদায় করত, এ সময় কৃষকরা ,যারা এক সময় জমির মালিক ছিলেন তারা দুঃখজনক ভাবে ভূমিদাসে পরিণত হোন। বেশিরভাগ জমিদার তার জমিদারি ও খাজনা আদায় পত্রের দায়িত্ব নায়েব-গোমস্তার হাতে ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় বিলাসী জীবনযাপনে মেতে থাকত। ফলে জবাদিহিতা ও অভিভাবকত্বের অভাবে সাধারণ মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে যায়। নায়েব-গোমস্তারা ইচ্ছামত অত্যাচার চালাতো কৃষকের ওপর। দেশীয় শিল্পগুলো এ সময় ভেঙ্গে পড়ে, অর্থনীতির মেরুদণ্ড গুড়িয়ে যায়।
মঠবাড়িয়ার প্রাচীন ইতিহাস মূঘল আমলে থেকেই গ্রোথিত। সুবেদার মুর্শিদ কুলি খাঁ আগা বাকের খাঁ কে পাঠিয়েছিলেন কির্তনখোলা নদীর তীর ঘেষে চন্দ্রদ্বীপের এলাকায় যা আগাঁ বাকের তাঁর নামানুসারে বাকের গঞ্জে নাম করন করা হয় । এই বাকের গঞ্জের মৌজায় আরো নিচূ এলাকায়
সাধুসন্নাসিদের একটা বড় মঠ ছিল। মঠের আশপাশের লোকালয় মঠবাড়ি
নামে পরিচিত ছিল।
কালক্রমে এই মঠবাড়ি হতে এলাকার নাম হয় মঠবাড়িয়া। এরপর এখানে একটা বাজার গড়ে ওঠে।
যার নাম মঠবাড়িয়া বাজার। মথা বাড়িয়া বাজারে ১৯০৪ সালে
থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হলে থানার নাম করন করা হয় মঠবাড়িয়া থানা। ১৯৮৩ সালে মঠবাড়িয়া থানা উপজেলার মর্যাদা লাভ
করে।
আনুমানিক আঠারো শতকের প্রথম
দিকে ইংরেজ সাহেব এডরয়ার্ড পেরি ক্যাসপার
ঘটনাক্রমে মঠবাড়িয়া
ভ্রমণে এলে অত্র এলাকার ধনাঢ্য ফরাজউল্লাহ
তাঁকে সম্মানিত করতে ১৪ বিঘা জমি জমি উপহার দেন। সেই ১৪ বিঘা জমিতে কুঠিবাড়ি নির্মিত হয়।
কুঠিবাড়ির মূলভবন নির্মাণে প্রচালিত ধারার বৃটিশ স্থাপত্যরীতিতে চৌকোণাকৃতির ১৮টি খিলানের উপর দোতলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য স্থাপনা ও বড় একটি পুকুর ছিলো। কুঠিবাড়ির উপরের তলায় প্যারি ক্যাসপারের ব্যক্তিগত ব্যবহূত মূল্যবান সামগ্রী ও তৈজসপত্র ছিল। পরবর্তীকালে এখানে ক্যাসপারের জমিদারী সমপ্রসারিত হয়। ক্যাসপার সাহেবের এই কুঠিবাড়িটি তখন এলাকার মানুষের কাছে সাহেব প্লাজা হিসেবে পরিচিতি পায়।
নীলকরদের অত্যাচারে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল জর্জরিত হলেও বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল তার বাইরে ছিলো বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। কিন্তু সুন্দরবন সংলগ্ন এই স্থাপনাটি এই অঞ্চলে যে ইংরেজ আমলে নীলচাষ করা হতো তার প্রমাণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বরিশালের ঠাকুর ষ্টেটের পশ্চিম পার্শ্বের বর্তমানে লুপ্ত হওয়া বাড়িটি নীলকর মনরোর বাসস্থান বলে কোনো কোনো স্থানীয় ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে উল্লেখিত নীলকর বরিশালের কোন স্থানে নীলচাষ শুরু করেছিলো তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া তদানীন্তন কালের বারৈকরন অর্থাৎ বর্তমানের নলছিটি অঞ্চলে আরো একজন নীলকরের নাম জানা যায়। কলভিন নামের এই নীলকর সম্ভবত বন্দোবস্ত নেওয়া কোনো জমিতেই সেই অভিশপ্ত নীলের চাষ করেছিলো বলে অনুমান করা অযৌক্তিক নয়। সুন্দরবন সংলগ্ন সাপলেজা কুঠিবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এওয়ার্ড পেরি কাসপার এই প্রকার পত্তনি গ্রহণ করা একজন কুঠিয়াল বা জমিদার। কুঠিয়াল কাসপার এখানে কখোনও বসবাস না করে, তার অতি বিশ্বস্ত কর্মচারি সুরেশ চন্দ্র সুর এবং সতীশ চন্দ্রের মাধ্যমে জমিদারি পরিচালনা করতো বলে জানা যায়। ফসল তোলা শেষ হলে জমিদার কাসপার নির্দিষ্ট দিনে খাজনা সংগ্রহ করে চলে যেত।
প্যারি ক্যাসপারের উপস্থিতিতে প্রতিবছর পৌষ মাসের শেষভাগে কুঠিবাড়িতে পুণ্যাহ উত্সব উপলক্ষে খাজনা আদায়সহ প্রজাদের মনোরঞ্জনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এর মধ্যে যাদু প্রদর্শনী, লোকগান, যাত্রা ও নিমাই সন্ন্যাস পালায় প্রচুর লোক সমাগম হতো। কথিত আছে, সোয়াহাত মাপের একজোড়া জুতা দিয়ে অভিযুক্ত প্রজাদের বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি দেয়া হতো।
১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তির সময়ই ব্রিটিশরা কুঠিবাড়ি থেকে চলে যায়।
তার আগে ক্যাসপার সাহেব চলে যারয়ার আগে
তার পিতা শিলার সাহেবের নামে
এলাকার নাম
শিলারগঞ্জ নামকরণ করে যান।
সাপলেজা পোষ্ট অফিসটি আজো শিলারগঞ্জ পোস্ট অফিস নামে পরিচিতি ধারণ করে আছে।
তবে লোকমুখে প্রচলিত প্যারি ক্যাসপার এখানে কুঠি বানালে স্থানীয়দের কাছে এই কুঠি সাহেব প্লাজা নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এই সাহেব প্লাজা নাম থেকে এলাকার নাম সাপলেজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পতনের পর ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পুর্ব পাকিস্থানের পার্লামেন্টে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ নামে বিল পেশ করা হয়। অবশেষে ১৯৫১ সালের ১৬ই মে এই বিল পাশ হয়, যার মাধ্যমে সুদীর্ঘ দেড়শ বছরের কালো জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে। এখানে উল্লেখ্য, কিছু কিছু গ্রামে তখনও জমিদারী প্রথা চালু ছিল যা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিলোপ করে, যুক্তফ্রন্ট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল এটি।
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments