স্বামী বিবেকানন্দ, সহজ ও সুন্দর উপায়ে বেদান্তের ফলিত রূপের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী
কোটি-সূর্যের আলোর ন্যায় ভাস্বর যে মুক্তপুরুষ সমগ্র জগতের মধ্যে হিন্দুধর্মের মহিমা প্রচার করেছিলেন, তিনিই স্বামী বিবেকানন্দ। একমাত্র স্বামী বিবেকানন্দই সহজ ও সুন্দর উপায়ে বেদান্তের ফলিত রূপের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, তৎকালীন সন্ন্যাসীদের মধ্যে তিনি কতটা যুগোপযুগী ছিলেন। নিম্নে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম-পরিচয়, শিক্ষা, গুরু, সাধনা ও লোকশিক্ষা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হল।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারী কলিকাতার শিমুলিয়া অঞ্চলে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দত্ত কুলোদ্ভব বিবেকানন্দের পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত এবং মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। ছেলেবেলায় তার নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাল্যেই স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার স্ফুরণ ঘটে। ছেলেবেলায় তিনি শিব, রাম, সীতা ও হনুমানের মূর্তির সামনে ধ্যানে বসতেন। তিনি ধর্মশাস্ত্র, সঙ্গীত, সাহিত্য ও শিল্পকলায় বিশেষ পাণ্ডিত্ব অর্জন করেছিলেন।
স্বামী বিবেকান্দ ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ চরম যুক্তিবাদী থাকলেও শ্রীরামকৃষ্ণের সহচার্যে এসে তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে বিবেকানন্দ প্রতিবেশী সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাক্ষাৎ পান এবং তখন তিনি তাঁকে গেয়ে শোনান সেই বিখ্যাত গান-মন চল নিজ নিকেতনে। ঈশ্বরের দর্শন লাভ সম্ভব কিনা-এই প্রশ্নের উত্তর খুজে বেড়াতেন যুক্তিবাদী নরেন্দ্রনাথ।
কিন্তু ঋষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেকের নিকট ঐ প্রশ্নের সদোত্তর না পেয়ে তিনি চলে যান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট। তাঁকেও করলেন ঐ সহজ প্রশ্ন-আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন? শ্রীরামকৃষ্ণও সহজ ভাষায় উত্তর দিলেন- ‘‘হ্যা, আমি তোমাকে যেমন আমার সামনে দেখছি তাঁকেও ঠিক সে রকম দেখি’’। উত্তন শুনে বিবেকানন্দের এত বৎসরের সঞ্চিত জ্ঞান-ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। কিছুকাল পরে স্বামী বিবেকানন্দ একবার দক্ষিণেশ্বরে গেলে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে পাশে বসিয়ে দক্ষিণ চরণ তাঁর দেহে স্পর্শ করেন।
তখন তাঁর মধ্যে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে। নরেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন যেন বিশ্বব্রহ্মার সব কিছু তাঁর মধ্যে লয়প্রাপ্ত হচ্ছে যেমনটি অর্জুনের হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক বিশ্বরূপ দর্শনের পর। পিতার মৃত্যুর পর নরেন্দ্রনাথের সাংসারিক দুঃখ বৃদ্ধি পায় এবং সেই সাথে তাঁর আধ্যাত্মিকতাও বৃদ্ধি পায়। সংসারের কোন কিছুই তাঁকে সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সংসারের নানা অভাব-অনটনের মধ্যেও চলতে থাকে তাঁর আধ্যাত্ম-সাধনা।
গুরুর কৃপায় কাশীপুরে স্বামী বিবেকানন্দ নির্বিকল্প সমাধী লাভ করেন। তারপর তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট গৈরিক বস্ত্র ও সন্ন্যাস লাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দেহত্যাগের পর তিনিই ভক্তদের মধ্যমণি হয়ে উঠেন। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ভক্তরা চাঁদা তুলে অর্থ সংগ্রহ করে স্বামী বিবেকানন্দকে অ্যামেরিকায় পাঠান শিকাগো বিশ্বধর্ম-মহাসম্মেলনে অংশ নিতে। তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম-মহাসম্মেলনে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করেন। স্বামী বিবেকানন্দ বক্তৃতার শুরুতেই
‘‘আমার প্রিয় অ্যামেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ’’ বলে সম্বোধন করলে উপস্থিত জনতার করতালী ও হর্ষধ্বনীতে মুখরিত হয়ে উঠে সভাস্থল। বৃটিশ শাসনামলে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বিশ্ববাসীর অস্পষ্ট ও নেতিবাচক ধারণা ছিল। তাছাড়া ঐ ধর্ম-মহাসম্মেলনের উদ্দেশ্যই ছিল বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করে খ্রীস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। স্বামীজীর বক্তৃতার পর তা আর সম্ভব হয়নি বরং হিন্দুধর্মেরই জয়ধ্বনি হয়েছে। তিনি উক্ত ধর্ম-মহাসম্মেলনে বক্তৃতা ছাড়াও অ্যামেরিকার ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ববাসীর নিকট হিন্দুধর্মের মহিমা প্রচার করেছিলেন।
তিনি বেদান্ত চর্চা ও প্রচারের জন্য ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কে বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। মিসেস ওলিবুল, জোসেফিন ম্যাকলিয়োড, ম্যাডাম মেরী লুই, মিস ডেট্রয়েটেড ক্রিস্টিনা। ড. লিয়োন ল্যান্ডস্-বার্গ, উইলিয়াম জেমস, জোসাই রয়েস, রবার্ট ডি ইঙ্গারসোল, নিকোলা টেসলা, লর্ড কেলভিন, হ্যারিয়েট মনরো, এলা হুইলার উইলকক্স, মি. ওয়াল্ডো গুডউইল, মি. লিগেট, মেরী ফিলিপ, মিসেস আর্থার, মিসেস গুডইয়ার, সারাহ বার্নহার্ডট, এমা কেলডি, হারম্যান লুডউইক, মি. স্ট্যাডি, সোভিয়ার দম্পত্তি প্রমুখ অ্যামেরিকা ও ইংল্যান্ডের ব্যক্তিবর্গ স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি অনুরক্ত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
বিদেশী শিষ্যদের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের মিস মার্গারেট নোবেল (ভগিনী নিবেদিতা) স্বামী বিবেকানন্দের খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন যিনি ভারতবর্ষে এসে আধ্যত্ম-সাধনা ও জীবসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বামীজী শুধু বেদান্ত প্রচারই নয়, বেদান্ত-দর্শনের ব্যবহারিক প্রয়োগ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তিনি বেদান্তবাদী হলেও মা কালীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি অটুট ছিল। তিনি ভক্তদের বোঝাতেন, শুধু আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারাই নয় জীবসেবার দ্বারাও ঈশ্বরকে লাভ করা যায়।
সর্বজীবেই ঈশ্বর বিরাজ করেন বলে জীবকে সেবা করলে ঈশ্বরকেই সেবা করা হয়। তাইতো তিনি সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়েছেন সে অমর বাণী-‘‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, বাল গঙ্গাধর তিলক, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, রোম্যারোলা প্রমুখ মনীশীগণ স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তিনি জীবসেবা ও ধর্মচর্চার নিমিত্ত ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের পহেলা মে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন যা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় স্থাপিত বেলুড় মঠ কর্তৃক পরিচালিত হয়। স্বামীজী সংক্ষিপ্ত জীবনের বৃহৎ কর্মযজ্ঞ শেষে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুলাই মহাসমাধীযোগে ইহলীলা সংবরণ করেন। "
No comments