ইসরাইল- ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব : পর্ব-১ । ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে কিভাবে গড়ে উঠে ইসরাইল রাষ্ট্র
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বলা যায় রাশিয়া-চীনের মতো দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিমাদের চলছে এক প্রকার ঠান্ডা যুদ্ধ। কে কার চেয়ে কত শক্তিশালী সেই হুমকি ধামকিতেই ব্যস্ত তারা। অন্যদিকে নীরবে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন একের পর এক ফিলিস্তিনি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত অধিকৃত পশ্চিম তীরে শতাধিক ফিলিস্তিনি ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ফিলিস্তিনিদের দুঃখ- দুর্দশার যেন অন্ত নেই। দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এর অন্যতম একটি কারণ জেরুজালেম শহর। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শহর হিসেবে পরিচিত জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে তা নিয়ে চলছে লড়াই। আজকে জানবো ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে কিভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।
এর পেছনে ব্রিটিশ ও পশ্চিমারা কি ভূমিকা পালন করেছে। ইসরাইলের সম্প্রসারণ, ফিলিস্তিনিদের দমন পীড়ন এসব কিছুর আদ্যপ্রান্ত।
১৫১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচের বেশিরভাগ অংশ সহ ফিলিস্তিন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তারও আগে এসেরিয়াম, ব্যাবিলনীয়, পার্সি সহ অনেকের নিয়ন্ত্রণে ছিল এই ভূখণ্ড। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নাটকীয়ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পথ পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ফিলিস্তিন ব্রিটেনের অধীনে চলে যায়। অবশ্য ১৯১৭ সালের নভেম্বরে তুরস্ক সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম নিজেদের দখল নিয়ে নেয় তারা। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনে নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর সে সময় ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে তাদের সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়।
ব্রিটিশদের ঐ সিদ্ধান্তের পরপরেই ১৯১৭ সালের ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব
লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে একটি চিঠি
লিখেন। জায়নিস্ট ফেডারেশন অব গ্রেট ব্রিটেন এন্ড আয়ারল্যান্ড নামক সংগঠনের কাছে
পাঠানোর জন্য চিঠিটি তাকে দেয়া হয়। এই চিঠি রেলফোর ডিক্লেয়ারেশন নামে পরিচিত।
ইহুদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনিদের
জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দেয়া হবে। যদিও রোমান সময় থেকে
ইহুদিদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সেখানে বাস করত।আরবরা এই বেলফোর ডিক্লেয়ারেশন
এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। অবশ্য আরো আগে থেকে ইহুদীরা
ফিলিস্তিনে নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের কথা ভেবে আসছিল। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৮২ সাল থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে
স্থানান্তরিত হয়। ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে আরো ৪০ হাজার এই এলাকায় বসতি
স্থাপন করে। ঊনিশ শতকে শেষ দিকে ইহুদিদের জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। তাদের চোখ পরে আরব ভূখন্ডে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইহুদীরা
ফিলিস্তিনে এসে বসতি গড়তে শুরু করে।
১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় এলে ইহুদিদের উপর শুরু হয় নির্মম
নিপীড়ন। সেখানকার হাজার হাজার ইহুদি অধিবাসী জাহাজে করে পালিয়ে আসে ফিলিস্তিনে।
এতে সেখানে ইহুদিদের তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। ফিলিস্তিনি আরবরা বুঝতে পারে যে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। তাই তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে
বিদ্রোহ করে। ব্রিটিশ শাসন ও ইহুদি দখলদারের বিরুদ্ধে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সালে সংঘটিত
হয় আরব বিদ্রোহ। যদিও সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। বলা হয় ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্রিটিশ সৈন্যরা এতটাই দমন- পীড়ন চালিয়েছিল যে আরব সমাজে ভাঙ্গন দেখা
দিয়েছিল। সেই বিদ্রোহে নিহত হন ৫ হাজারেরও বেশি আরব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনীর হাতে লাখ লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডের
পর তৈরি হয় নতুন বাস্তবতা। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যেসব
ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য কি করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডেই ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র
তৈরি করার চিন্তা আরো জোরালো হয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস
ট্রুম্যান ইসরাইলিদের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন।
ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া
এক লাখ ইহুদিদের যেন অতি দ্রুত ফিলিস্তিনে জায়গা দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন কথায় পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নেয়। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ব্রিটেন তারাই এবার
বিরোধিতা শুরু করে। ব্রিটেন বুঝতে পেরেছিল বিশাল সংখ্যক ইহুদি সেখানে গেলে
স্থানীয় আরবদের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। ব্রিটেনের এমন মনোভাবে
তাদের শত্রু ভাবতে শুরু করে ইহুদীরা। আরব ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে
ইহুদিরা। ব্রিটেনের উপর চাপ তৈরি করতে থাকে। একপর্যায়ে ফিলিস্তিনের উপর ম্যান্ডেট ছেড়ে দেয়া সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। একই সঙ্গে এই ভূ-ভাগ্য নির্ধারণে
অনুরোধ জানানো হয় সদ্য গঠিত জাতিসংঘকে।
১৯৪৭ সালে নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত
নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদের, অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদীরা মোট ভূখণ্ডের দশ
শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। স্বাভাবিকভাবে আরবরা এ সিদ্ধান্ত
মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নীল নকশাত ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ
প্রশস্ত হয়। ১৯৪৮ সালে ১৪ মে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট
ছেরে দেয়। ঐদিনই ইহুদি নেতার ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। আর এরপরের দিনই আরব
দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হলে তাদের একটা
বড় অংশ দখল করে ইসরাইল। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরনার্থী হয়। অনেক
ইতিহাসবিদ মনে করেন, সেই সময় ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি যে নেতিবাচক
দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাকে আরো ত্বরান্বিত
করেছে।
১৯৪৭ সালের আগেও ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ইহুদীরা ছিল মোট ৬ শতাংশ। কিন্তু ১৯৪৮
সালে নাগবা বা ফিলিস্তিনের জাতিগত নিধন শুরু হয়। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর কমপক্ষে ৭ লাখ ৫০ হাজারের মতো ফিলিস্তিনকে
বিতাড়িত করে। ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ৭৮ শতাংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৬৭ সালে
আরব -ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনে ঐতিহাসিক সব স্থান দখল করে।
এমনকি আরো ৩ লাখের মতো ফিলিস্তিনকে তাদের বাড়ি- ঘর ছাড়রে বাধ্য করে। এখনো ক্রমাগত
জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের ঘর- বাড়ি জমি ছাড়তে বাধ্য কর
চলেছে ইসরাইল। তাদের ভুমি অবৈধভাবে দখল করে বসতি স্থাপন করছে ইহুদিরা।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিন-ইসরাইল
দ্বন্দ্বের কারণে ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অন্তত ৫ হাজার ৭৩৯ জন ফিলিস্তিনি
নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার ৪৩৮ জন ফিলিস্তিনি। এদের মধ্যে ২২
শতাংশই শিশু ও ১০ শতাংশ নারী।
ইসরাইলিদের হাতে এখনো প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। অধিকৃত পশ্চিম
তীর ও জেরুজালেমে অভিযানের নামে প্রতিদিনই চলে ধরপাকন। প্রাণ হারাচ্ছেন নিরিহ
ফিলিস্তিনিরা। চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত শতাধিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন বলে
জানা সংবাদ মাধ্যম বিবিসি। যাদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকই বেশি।
ফিলিস্তিনিদের অবস্থান নিজ ভূমিতে পরবাসের মতো। তাদের সকল স্বাধীনতা হরণ করেছে ইসরাইল। কাঁটাতারের
বেড়ায় বন্দি তাদের জীবন। চলে সার্বক্ষণিক নজরদারি আর হয়রানি। নিজেদের আবাদি
জমিতে যেতে হলেও নিতে হয় পাশ। নজরদারি পাশাপাশি
ইসরাইলরা ফিলিস্তিনিদের পানি সহ প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগের অধিকারও কেড়ে নিয়েছে।
একটা নতুন ঘর তুলতেও লাগে অনুমোদন। অনেকেই দাবী করেন, ফিলিস্তিন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প। মানবাধিকার সংগঠন
এর প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনদের দুঃখ দুর্দশা চিত্র তুলে ধরে। ফিলিস্তিনিরা কোথায়
যাচ্ছে, কি করছে, তা নিয়ন্ত্রণ
করে ইসরাইলি বাহিনী। পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বাহিনীর শতাধিক চেক
পয়েন্ট রয়েছে। ৬৭ ও বেশি সড়কে পড়তে হয় ইসরাইলি সেনাদের বাঁধার মুখে।
ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় এসব চেক পয়েন্টে। স্কুল -কলেজ, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম এমনকি খাবার
সংগ্রহের জন্য দরকার হয় ইজরাইলিদের অনুমতি। এমন কি আল আকসা মসজিদে নামাজ আদায়েও
প্রয়োজন ইসরাইলিদের অনুমতি। ৭০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিশাল এক প্রাচীর গড়ে তুলে
বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের। ২০০২ সালে নির্মিত ৮ মিটার উচ্চতার
প্রাচীরটির বেশিরভাগই ফিলিস্তিনিদের আবাদি জমিতে নির্মিত।
জেরুজালেমে কেন প্রার্থনা নিয়ে দ্বন্ধ তা নিয়ে চোখ রাখুন ২য় পর্বে।
follow our Twitter account Dhaka Voice
No comments