সাঁকো থেকে যেভাবে ‘যশোর’ নামের উৎপত্তি
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার মন কাড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ ও মিনার, নদী, পাহাড়, অরণ্যসহ হাজারও সুন্দরের রেশ ছড়িয়ে আছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত।
দেশের আট বিভাগে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ) ৬৪ জেলা। পণ্য, খাবার, পর্যটন আকর্ষণ কিংবা সাংস্কৃতিক বা লোকজ ঐতিহ্যে বাংলাদেশের জেলাগুলো স্বতন্ত্রমণ্ডিত। প্রতিটি জেলার নামকরণের সঙ্গে রয়েছে ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস। প্রতিটি স্থানের নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু জনশ্রুতি রয়েছে। এসব ঘটনা ভ্রমণপিপাসু উৎসুক মনকে আকর্ষণ করে। তাই বাংলা ট্রিবিউন জার্নিতে ধারাবাহিকভাবে জানানো হচ্ছে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার নামকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য যশোর জেলার সৃষ্টি প্রায় ২০০ বছর আগে, ১৭৮৬ সালে। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন জেলা। মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম শত্রুমুক্ত হয় যশোর।
যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত মেলে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই জেলার নামকরণ সম্পর্কে মতবিরোধ দেখা যায়। আরবি ‘জসর’ থেকে যশোর শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন অনেকে। এর অর্থ সাঁকো। এককালে যশোরের সর্বত্র নদীনালায় পরিপূর্ণ ছিল। নদী বা খালের ওপর সাঁকো বানানো হতো। পীর খানজাহান আলী বাঁশের সাকো নির্মাণ করে ভৈরব নদী পেরিয়ে মুড়লীতে আসেন বলে জানা যায়। বাঁশের সাঁকো থেকে যশোর নামের উৎপত্তি। তবে অনেকের অভিমত, খানজাহান আলী আসার আগে থেকেই ‘যশোর’ নামটি ছিল।
জেলার ঐতিহ্যের মধ্যে আছে জেলা প্রশাসকের বাংলো, কালেক্টরেট ভবন, দড়াটানা, মারকাজ মসজিদ, শতাব্দী প্রাচীন যশোর পৌরসভা, লালদীঘি পুকুরপাড়, রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরি, নকশীকাঁথা ও যশোর স্টিচ, যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি, বেনাপোল স্থলবন্দর। এর মধ্যে বেনাপোল স্থলবন্দরে প্রতিদিন বিকালে থাকে ‘রিট্রিট সিরিমনি’। সূর্যাস্তের সময় বেনাপোল সীমান্তের শূন্যরেখায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে ও পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সামরিক কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে।
যশোরের ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলায় ফুলচাষের মহাযজ্ঞ দেখা যায়। সবুজের মাঝে সাদা রজনীগন্ধা আর লাল গোলাপ ও হলুদ গাঁদার মনমাতানো নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে সেখানে। বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠে মাঠে লাল, হলুদ, খয়েরি ও হলুদসহ রঙের বাহার। প্রায় ১০০ গ্রামে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে রজনীগন্ধা, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, কালো গোলাপ, হলুদ গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রথস্টিক, জিপসি, গ্যালেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকা, লিলিয়াম, গাঁদা, জবা ও জুঁইসহ হরেক রকমের ফুল।
‘খেজুরের রস যশোরের যশ’ বাংলার মানুষের মুখরোচক প্রবাদ। একসময় যশোর অঞ্চলের প্রধান কৃষিপণ্য ছিল খেজুরের গুড়। যশোর ব্যতিত বাংলাদেশের কোথাও পাটালি গুড় পাওয়া যায় না। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ হাউজ চৌগাছার তাহেরপুরে খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই চিনি সামান্য লালচে, কিন্তু বর্তমানে আখের চিনির মতো ঝরঝরে ছিল। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, একসময় চিনি ছিল যশোরের প্রধান অর্থকরী পণ্য। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ছাড়াও বাদামি চিনি রফতানি হতো ইউরোপে।
যশোরের ঐতিহ্যের অন্যতম একটি অংশ মধুমেলা। প্রতি বছর মধুসূদনের জন্মবার্ষিকীতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এর আয়োজন করা হয়। যশোরের দর্শনীয় স্থানের তালিকায় আছে ঝাপা বাওড়, দমদম পীরের ঢিবি, তুলা বীজ বর্ধন খামার, খড়িঞ্চা বাওড়, গদাধরপুর বাওড়, মধুপল্লী, ভরতের দেউল, কালুডাঙা মন্দির, চাঁচড়ার মৎস উৎপাদন কেন্দ্র, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্মৃতিস্তম্ভ, চাঁচড়া রাজবাড়ী, যশোরের বধ্যভূমি, যশোর বোট ক্লাব, বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক, কেশবপুরের কালোমুখ হনুমান, ৩০০ বছরের পুরনো পীর মেহেরুদ্দিনের (রা.) মাজার, মির্জানগর হাম্মামখানা, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি।
No comments