Adsterra

লোকগান শুদ্ধতার ধার ধারে না


লোকগান শুদ্ধতার ধার ধারে না, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, লোকগান ব্যক্তির রচিত হলেও তা রচনাকারীর কবজাধীন নয়, Today Trending News, Today Viral News

সমাজে একশ্রেণির মানুষ সংস্কৃতির নানামুখী বদল মানতে নারাজ। অথচ খোদ সংস্কৃতি প্রপঞ্চটিই বদলকামী। সমাজ, ইতিহাস ও সময়ভেদে এর রূপের নানান বদল ঘটে। কিন্তু এই বদল নিয়েই বিড়ম্বনার শেষ নেই। বিষয়টা বিশেষভাবে লোকগানের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটে থাকে। বাণিজ্যনির্ভর মিডিয়া-সংস্কৃতির কালে কিছুদিন পর পর লোকগান নিয়ে হইচই ওঠে। কেউ লোকগান বা তার কথা-সুরকে নিজের মতো করে ব্যবহার করলেই যেন একটা কেলেঙ্কারি ঘটে! বিড়ম্বনা আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন সংগ্রহ-সংরক্ষণ প্রকল্প লোকগানের একক প্রামাণ্য রূপ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এবং লোকগান চর্চায় থাবা বসায় শুদ্ধাশুদ্ধি ভাবনা। অথচ লোকগান অন্য গান থেকে আলাদা তার সহজাত অপরিশীলিত ‘অশুদ্ধতা’ দিয়েই, তার পাঠ-বৈচিত্র্যের জন্যই।


বিশিষ্ট মার্কিন ফোকলোরবিদ জ্যান হ্যারল্ড ব্রনভান্ড ও বার টোলকেনের বরাতে বলা যায়, লোকগান ব্যক্তির রচিত হলেও তা রচনাকারীর কবজাধীন নয়। বরং গোষ্ঠীগত কোনো যৌথ বোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ গায়ক মাত্রই সেটিকে নিজস্ব করে নেয়। কাজেই লোকগানের সবচেয়ে স্বাতন্ত্র্যজ্ঞাপক লক্ষণ হলো তার এক বা একাধিক পাঠান্তর, যা মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে বা তারই প্রভাবে প্রবহমান থাকে। প্রাথমিকভাবে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি গান যখন স্মৃতি-শ্রুতির মধ্য দিয়ে বাহিত হয়, তখন তাতে ভাষাগত-সুরগত যে কিছু কিছু পরিবর্তন স্বভাবতই ঘটে থাকে, তার ফলেই সেই গানটি লোকজীবন পেয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত লোকগান গোষ্ঠীগত যৌথ বোধে জারিত, মৌখিকতামুখ্য ঐতিহ্যজনিত পাঠান্তর প্রবণতা পুরোপুরি হারিয়ে না ফেলে, ততক্ষণ তা লোকগানই থাকে। লোকগান স্রেফ বিনোদন বা বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সাজ বা পরিকল্পনার ভার নিয়ে পেশাগত লোকশিল্প গোষ্ঠীর ভান্ডারে প্রবেশ করলে যেমন তার আসল বৈশিষ্ট্যই হারিয়ে ফেলে, ঠিক তেমনি যখন কোনো লোকগান তার স্বাভাবিক পাঠবৈচিত্র্য বা পাঠান্তরের গ্রহণযোগ্যতা খুইয়ে শুদ্ধতাবাদিতার পাতে গিয়ে ওঠে, তখন সে নিজের লোকজীবন থেকে বিযুক্ত হয়ে যে জীবনে পা রাখে, তা হচ্ছে ধ্রুপদি গান বা জনপ্রিয় গান বা অন্য কোনো ধারার গানের জীবন।


হালে এ দেশের অক্ষরশিক্ষিত সমাজে বাউলগান চর্চার বিষয়ে শুদ্ধতাবাদী একটা শোরগোল শোনা যায়। অথচ মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ভিন্ন চিত্র। বিশেষ এক সাধনার ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে এই গানের চর্চায় যুক্ত থাকায় লোকগানের অন্যান্য ধারার তুলনায় বাউলগানের প্রতি গায়ক-সাধকদের সংবেদনশীলতা বেশি থাকে। অর্থাৎ এদের মধ্যে এ জাতীয় গানগুলোকে ‘পবিত্র’ জ্ঞান করার প্রবণতা দেখা যায়। তারপরও কথ্য পরম্পরায় ছড়ায় বলে এ গানেও অল্পবিস্তর পাঠান্তর থাকেই। অনেক ক্ষেত্রে রচনাকারীর নাম নিয়েও সন্দেহ দেখা যায়। এমনকি লালন ফকিরের গান নিয়েও দেখা যায় এমন সংশয়। আসলে, আগেই যেমনটি বলা হয়েছে, লোকগানে ব্যক্তিগত স্বত্ববোধের চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ  হয়ে ওঠে যৌথ গোষ্ঠীচেতনা। যেভাবে দিন দিন শুদ্ধস্বর নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাউলগানকে কট্টর রীতিনীতিতে বেঁধে এর সংরক্ষণ আর চর্চায় গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে তাতে, বোধ করি, অচিরেই লোকগানসুলভ পাঠবৈচিত্র্য প্রবণতা ও প্রাণময়তা হারিয়ে বাংলার বাউলগান ধ্রুপদিধারায় পর্যবসিত হবে।


বাউলগানসহ অন্যান্য লোকগান যে রকম বাণিজ্যিকভাবে পুনরুৎপাদিত হচ্ছে, সেসব নিয়ে যা যা নিরীক্ষামূলক পুনঃসৃষ্টি হচ্ছে সংমিশ্রণ ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেসবই লোকজীবনবহির্ভূত ক্রিয়াকলাপ বৈকি। তবে লোকগানের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর বা অবমাননাজনক বলে মনে হয় না। কারণ, লোকত্ব অটুট রেখে কোনো লোকগানের উপস্থাপনই অসম্ভব; জাতীয় সম্পদের সঙ্গে সর্বসাধারণের সম্পর্ক স্থাপনের মহান উদ্দেশ্যে খাঁটি লোকশিল্পীদের দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে যতই আদি ও অকৃত্রিম রূপে লোকগানকে পরিবেশন করার চেষ্টা করা হোক, তাতেও সে পরিবেশনার কৃত্রিমতা কখনো কাটে না। লোকগান তার আদি পরিপ্রেক্ষিত ও লোকনির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যের বাইরে বেরোলে লোকজীবনের গণ্ডি থেকেও বেরিয়ে যায়, পরিণত হয় ফলিত লোকগানে।


পুনরুৎপাদনমুখী, নিরীক্ষাপ্রবণ কোনো প্রয়াসই সাধারণত দাবি করে না যে, সে নির্ভেজাল লোকঐতিহ্য ধারণ করছে! একটি লোকগান তার রূপ বা পাঠবৈচিত্র্য নিয়ে লোকপরিসরে যাপন করে তার লোকজীবন, আবার একই সঙ্গে অন্যান্য পরিসরে সে ভিন্ন ভিন্ন জীবনেও বেঁচে থাকতে পারে। এদের মধ্যে সংঘাত অনাবশ্যিক। বরং প্রামাণ্য জাতীয় লোকঐতিহ্য দাঁড় করানোর জাতীয়তাবাদী আজ্ঞা মাথায় নিয়ে যাঁরা লোকগানকে বিন্যস্ত, পরিশীলিত ও সুসম্পাদিত করে তুলতে চান, তাঁদের হাতে লোকগানের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেহেতু তাঁদের প্রবণতা থাকে লোকগানের স্বভাবসুলভ পাঠান্তরকামিতাকে উপেক্ষা করার। তাঁদের কর্মযজ্ঞের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে একরকম মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে বলেও মনে হয়, যা একক প্রামাণ্যতাকে অলঙ্ঘনীয় জ্ঞান করে লোকগান পরিবেশনায় সামান্যতম পাঠান্তর বা রূপান্তর দেখলেই ‘জাত গেলো, জাত গেলো’ রব তোলে। এ-দিক বিবেচনায়, জাতীয় ঐতিহ্যের কোনো কোনো বরকন্দাজের চেয়ে নিরীক্ষাবণিকেরা লোকমর্মের বেশি কাছাকাছি—এমনটা মনে করা যেতেই পারে, যেহেতু পাঠবৈচিত্র্যে ভরসা লোকগায়ক ও নিরীক্ষাবণিক উভয়েরই মূলমন্ত্র।


এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে যে, সমাজ-মনস্তত্ত্ব, আঞ্চলিকতা, পরম্পরাগত গোষ্ঠীচেতনা, আবেগ এসব ছাপিয়ে এই পাঠবৈচিত্র্য বা পাঠান্তর হচ্ছে এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা দিয়ে লোকগানকে সবচেয়ে নির্ভুলভাবে চেনা যায়। বেশ কিছুদিন আগে সিলেট অঞ্চলের একটি লোকগান নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে এখন সহজেই লোকগানের বদল ও এর রচয়িতা নিয়ে বিতর্কের গতিবিধি আমাদের নজরে আসে। একটি লোকগান কালের প্রবাহে কীভাবে এর একাধিক পাঠান্তর বহন করে সত্যিকারের লোকগানের মান্যতা পায় এবং ব্যক্তিরচিত হলেও যে তা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক থাকে না বরং এর পরিবেশনের পরিবর্তনে কতভাবে যে এই গান লোকজীবনে প্রবাহিত হয়ে চলে, তা গবেষক ও গায়কদের মাধ্যমে জানা যায়। গানটির একক রচয়িতা নিয়েও শেষ পর্যন্ত বিতর্কের অবসান ঘটে। হ্যাঁ, আমি ‘আইলারে নয়া দামান আসমানেরও তেরা’ বা পাঠান্তরে ‘আইলা রে নোয়া জামাই আসমানেরও তারা’ এই জনপ্রিয় লোকগানের কথাই বলছি। এমন অসংখ্য লোকগান নিয়ে এ দেশে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণা হবে ততই আমরা লোকগানের এহেন পাঠান্তরের বৈশিষ্ট্যটি প্রত্যক্ষ করতে পারব এবং এর অপরিহার্যতার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠব।


এ দেশের লোকগানের ভান্ডার বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। অসংখ্য এর শ্রেণিবিভাগ। সে আলোচনার বিস্তারিত সুযোগ এখানে নেই। তবে আমরা যদি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠিত লোকগানের ধরনের মধ্যে অল্প কয়েকটি নিয়ে কথা তুলি, যেমন ভাটিয়ালি, সারি, বিয়ের গান, তবে দেখতে পাব, লোকগান কীভাবে লোকমানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত থেকে বিকশিত হয়েছে। যে মাঝি একদা অপার নদীর জলকল্লোলের নির্জনতার মধ্যে বইঠা চালাতে চালাতে জগৎজীবনের নানান বোধের প্রকাশে গান গেয়ে উঠেছেন একান্তে, সে-মাঝির গানের কথা-সুরের বৈশিষ্ট্যে তার নদীকেন্দ্রিক পরিবেশের-পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব লক্ষণীয়। সারি গান, বিয়ের গান—এগুলো সাধারণত সামাজিক উপযোগিতাকে লক্ষ্য করে নানান উপলক্ষে গাওয়া হয়ে থাকে। সারিগান সমবেত নৌকাবাইচের দ্রুততার সঙ্গে যুক্ত বলে এর সুর-তালেও অন্য রকম তীব্রতা, ক্ষিপ্রতা লক্ষ করা যায়। আবার বিয়ের গানগুলোতে নারী-পুরুষের জাগতিক জীবনের নানান প্রসঙ্গ সামষ্টিক আবেগ অনুভূতিসিক্ত হয়ে পরিবেশিত হয়। এমন সব গীতের কোনো কোনোটি কোনো এক নারীর রচনা হলেও এ গানের রচয়িতা নিয়ে কিছু আসে যায় না। গানগুলো তার ভাবের জায়গা থেকে সমবেত নারীর অনুভূতির যৌথতা প্রকাশ করতে গিয়ে প্রত্যেকের একান্ত গান হয়ে ওঠে। অনেক শারীরিক কাজকর্ম ঘিরে লোকগান রচিত হয়েছে, যেগুলো সমবেত কঠিন শ্রমকে সহজ করে সারতে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে।


বোঝা যায়, নিছক বিনোদন দেওয়ার জন্য বা জাতীয় ঐতিহ্য পরিবেশনের জন্য লোকগান তৈরি হয় না। এসব গান মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লে এগুলোর এক বা একাধিক পাঠান্তর তৈরি হতে বাধ্য। এ নিয়ে লোকপরিসরে কোনো দ্বন্দ্বের কথা জানা যায় না। কপিরাইটের বাধ্যবাধকতা লোকগানের ক্ষেত্রে একেবারেই গৌণ।


রবীন্দ্রনাথের গান স্বত্বাধিকারের অধীনে লিখিত রূপেই লিপিবদ্ধ; প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কঠোর রীতি-অনুশীলনে এর চর্চা বাহিত হয়। একদা এই গানের চর্চায় অনেক বেশি কঠোরতা আরোপিত ছিল কিংবা এখন খানিক এ বিষয়ে শিথিলতা এলেও এ গানের গড়ন ও শ্রোতা এখনো পরিশীলিত সমাজেই সীমাবদ্ধ। বিপরীতে, লোকগানের মূল সীমানা তুলনামূলকভাবে অপরিশীলিত সমাজগোষ্ঠীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত। তবে সময়ের বদলের সঙ্গে, মিডিয়ার সর্বগমনের কারণে, শিক্ষার হার বাড়ার কারণে, লোকগানের আদি পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে আর সর্বোপরি বর্তমান উদার-নীতিবাদের বাজারনির্ভর সমাজে সব গানই নানাভাবে স্থানান্তরিত হতে পারে। এই স্থানান্তরের পাটাতনে জনপ্রিয় গান কখনো লোকগানে গমন করতে পারে। আবার লোকগানও তার আদিরূপ হারিয়ে জনপ্রিয় ধারায় গমন করতে পারে। ইতিহাসে দেখা গেছে, এমনকি ধ্রুপদি গান কালের ধারায় লোকগানে চলে এসেছে কিংবা একদার লোকগান চলে গেছে ধ্রুপদি ধারায়। এই গমনাগমন অস্বাভাবিক, অগ্রহণযোগ্য কিছু নয়। ন্যায়ত, মুশকিল তখনই হতে পারে যখন যা লোকগান নয় বা আর লোকগান নেই, তাকেও আদি-অকৃত্রিম লোকগান বলে চালানোর চেষ্টা করা হবে।


তবে যেকোনো দেশের জাতীয় সংগীত সেসব দেশের মানুষের গোষ্ঠীগত আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাকে আমরা লোকগান কিছুতেই বলতে পারি না। কেননা, জাতীয় সংগীত পরিবেশনের কট্টর রীতিনীতি থাকে, থাকে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন। ফলে জাতীয় সংগীতে কোনোভাবেই পাঠান্তরের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু লোকগান সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ, আর সব গানের মধ্যে একমাত্র লোকগানই কোনো কট্টরতা, কোনো শুদ্ধতার ধার ধারে না। 


সুস্মিতা চক্রবর্তী, অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com

 follow our Facebook page DHAKA Voice

follow our Twitter account Dhaka Voice 

No comments

Powered by Blogger.