ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট : পর্ব-৩। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলো চুপ কেন ?
১৯৪৮ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মিত্রদের সহযোগিতা দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে ইসরাইল। ষাটের দশকের মধ্যেই পারমাণবিক বোমার মালিক হয়ে যায়। দখলদারি ও ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতা আরো বাড়তে থাকে। ফিলিস্তিনিদের দমন পীড়ন ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট দমন করতে বিশ্ব নেতাদের তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র দেশে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে ১৪ই মে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রথম হেরিট ট্রুম্যান প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে ইসরাইল রাষ্ট্র টিকে থাকার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ওয়াশিংটনের। নিজ স্বার্থ রক্ষার্থেই ইসরাইল- ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে খুব বেশি সোচ্চার হতে দেখা যায় না যুক্তরাষ্ট্রকে।
এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোকেও নীরব ভূমিকায় দেখা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কি স্বার্থ? আরব দেশ গুলোরই বা নিরব ভূমিকা কেন? এসব প্রশ্নের
উত্তর জানবো আজকের প্রতিবেদনে।
১৯৬৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্পর্ক ঘনিষ্ট হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে
আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষ নেয়। অনেক গবেষকদের মতে, ওয়াশিংটন খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে
মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ইসরাইল তাদের কার্যকরী অস্ত্র হয়ে
উঠতে পারে। মধ্যপ্রাচীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক
দূরত্ব ঘোচাতে শক্ত ঘাঁটি নির্মাণের তারা বেছে নেয় ইসরাইলকে। ওয়াশিংটন তখন তেল
আবিবে এর সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির
জন্য তাদের হয়ে ফিলিস্তিনের সাথে দেন-দরবারের দায়িত্ব দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের
সমর্থনের পাল্লা ইসরাইলের প্রতি বেশি ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এখনও তাই
কিন্তু কেন?
বিশ্লেষকদের মতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্ক
রয়েছে। যুক্তরাষ্টের জন্য ইসরাইল গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। ১৯৮৫ সালে তেল আবিবের
সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে বিভিন্ন
ব্যবসা করে আসছে যা থেকে মার্কিন অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে । অন্যদিকে ওয়াশিংটন ও
তেল আবিবেতে বিপুল অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে। আশির দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসরাইল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠে।
দেশটির অধিকাংশ নাগরিক ইসরাইলিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে
যারা তেল আবিককে সমর্থন করে তাদের ভালো চোখে দেখা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, মার্কিন নাগরিকদের প্রায় ৭০ ভাগে তেল আবিবকে সমর্থন করে।
সেখানকার খ্রিস্টান ইহুদি ও উদারবাদী মতাদর্শ সবারই সমর্থন পায় ইসরাইল। যা তাদের
মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। মার্কিন গণমাধ্যমগুলোতেও
ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরাইলিদের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। দেশটির গণমাধ্যমে
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংক্রান্ত সংবাদ বিশ্লেষণ করে মাইকেল ব্রাউন ও আলী আবু নিমাহ বলে, " মার্কিন গণমাধ্যম এর দৃষ্টিতে ফিলিস্তিনিদের
চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান ইসরাইলিদের জীবন।"
আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি অর্থাৎ IPAQ এটি ইসরাইল সমর্থক একটি মার্কিন লবিং গ্রুপ। রাজনৈতিক কোনো সংগঠন না হলেও মার্কিন পরাষ্ট্রনীতি গঠনে এর বেশ
প্রভাব রয়েছে। কংগ্রশনাল ক্লাব নামে IPAQ
এ একটি বিশেষ দল রয়েছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি নির্বাচনে সর্বনিম্ন ৫০০০
ডলার চাদা দিয়ে থাকে
আর এই অর্থ ইসরাইলপন্থী রাজনীতিবিদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। পরবর্তীতে এদের
মধ্যে যারা জয়লাভ করে তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে
নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে ওয়াশিংটন।
ট্রাম্পের শাসনামলেই IPAQ অনেকগুলো সফলতা অর্জন করে। এর মধ্যে রয়েছে
জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে
করা পারমাণবিক শক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আশা এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য
সহায়তা বন্ধ করে দেয়া।
যে আরব রাষ্ট্র এক সময় ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, তারাই আজ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটে নিশ্চুপ। ফিলিস্তিনিদের উপর দিনের পর দিন
নির্যাতন- নিপীড়ন চালানো সর্ত্ত্বেও তেলা আবিবের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ
ব্যর্থ মুসলিম দেশগুলো। বরং বিভিন্ন সময় ইসরায়েলের সঙ্গেনানান ধরনের
চুক্তিতে জড়িয়েছে তারা। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-ওর্পোরেশন বা OIC জাতিসংঘের পর সবচেয়ে বড় আন্তদেশীয় জোট।
মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থা। অথচ প্রতিষ্ঠানটি ফিলিস্তিনিদের জন্য তেমন
কোনো ভূমিকায় রাখেনি বলে মনে করেন অনেকেই। বলা হয়ে থাকে আরব দেশগুলো এক হলে ইসরাইলকে ঠেকানো খুবই কঠিন নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্য গবেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশ গুলো এই অঞ্চলে এমন এক পরিচিতি তৈরি করে রেখেছে
যেখানে আরব দেশ গুলো ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ থাকতে বাধ্য। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল ছোট্ট একটি রাষ্ট্র বা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে
নয়। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে যুদ্ধ।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির
পাশাপাশি, পশ্চিমা অনেক দেশের ক্রোধানলে পড়তে হতে পারে।
তাই নিজস্বার্থ রক্ষায় কিংবা ভয় থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোকে নিরব
থাকলে দেখা যায় বলে মনে করেন কেউ কেউ।
ফিলিস্তিনিদের হত্যা, তাদের উপর ইসারাইলি বাহিনীদের নির্যাতন, নিপীড়নকে জাতিগত নিধন হিসেবে দেখেন বিশ্লেষকরা। ইতিহাসবিদ ও গবেষক ' ইলাম পাপ্পে' তার বইয়ে ফিলিস্তিনিরা জায়নবাদী ইসরাইলের
জাতিগত নিশ্চিহ্ন করণের শিকার বলে মন্তব্য করেছিলেন।
বর্তমানে ফিলিস্তিনিদের মত জাতিগত নিধনের শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ক। অধিকাংশ গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মুসলিম বিদ্যেষ থেকে এই ধরনের জাতিগত নিধন চালানো হয়। 911 এর পর মুসলমানদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ করে পশ্চিমাদের মনোভাব বদলে যেতে থাকে। খারাপ এবং ভালো এই দুই ক্যাটাগরিতে মুসলমানদের বিভক্ত করা হয়। আর এমন দৃষ্টিভঙ্গির বলি ফিলিস্তিন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও চীনের উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠী।
গত নভেম্বর ইসরাইলের সাধারণ নির্বাচনে জয় পেয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যিনি ফিলিস্তিনি বান্ধব নয় বলে পরিচিত। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবারে প্রধানমন্ত্রী হলে কঠোর
পন্থী সরকার গঠন করবেন। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এই সম্ভাব্য কঠোর পন্থী সভা নিয়ে গঠিত হয়েছে উদ্বেগ। আগামী জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার কথা
রয়েছে তার। নেতানিয়াহুর শাসনে
ফিলিস্তিনিদের দুঃখ দুর্দশা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা
হচ্ছে। যদিও অনেক ফিলিস্তিনি বলছে, যেই ক্ষমতায়
আসুক না কেন তাদের ভাগ্য অপরিবর্তনীয়।
নিজেদের স্বার্থের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশিই ইসরাইলকে টিকিয়ে
রাখতে সমর্থন যোগিয়ে রেখেছে বলে মত বিশ্লেষকদের মতে। দিনের পর দিন ফিলিস্তিনিদের
ভূমি দখল করে ইসরাইলের সম্প্রসারণ বাড়লেও নাম মাত্র হুমকি ধামকি আর হুঁশারিয়া
ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা ও আরব দেশগুলোকে তেমন কিছুই করতে দেখা যায় না। তবে তারা চোখ থাকলেও ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সোচ্চার বিশ্বের সাধারণ মানুষ। যার
প্রমাণ পাওয়া যায় এবারের কাতারের ফুটবল বিশ্বকাপে। খেলা উপভোগে দোহায় জড়ো
হয়েছেন বিশ্বে নানা প্রান্তের মানুষ। মরক্কো বেলজিয়াম আসরে মরক্কোর জয় লাভের পরে স্টেডিয়ামে free
Palestine লেখা সম্মলিত
ফিলিস্তিনিদের পতাকা উড়ানো হয়। এদের প্রতীক সম্মলিত ব্রেসলেট পড়তেও দেখা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতারের এই আসর আরববাসীকে নতুন একটি সুযোগ
করে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন প্রদানের পাশাপাশি, নব্য উদ্দেশ
বাদী নীতির আরব শাসকদের বিরুদ্ধে ও তাদের
অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। আর এই পরিস্থিতি আরবদের পুরনো দিনের কথা স্মরণ
করে দিচ্ছে। যখন আরবে নাগরিকরা নিজেদের মর্যাদা ও স্বাধীনতার দাবির পাশাপাশি, ফিলিস্তিনের পতাকা তুলে ধরার সুযোগ পেতেন। এবং ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য
স্লোগান দিতেন।
No comments