Adsterra

রাজকন্যার পুত্র ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রা.)

রাজকন্যার পুত্র ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রা.), ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, কৃষ্ণাঙ্গ এই দম্পতির ঘরেই জন্ম নেন হযরত বেলাল (রা.), Today Trending News, Hot News

ধর্মের জন্য ত্যাগ স্বীকার
, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করা এবং নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সামনে এগিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে নিতান্ত কম নয়। তবে ইসলামের প্রাথমিক যুগে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেও এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হযরত বিলাল ইবনে রাবাহ আল হাবাসি (রা
.) ।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মের ১০ বছর পর ৫৮০ সালে সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলীয় জনবসতি হেজাজ এ জন্মগ্রহণ করেন হযরত বেলাল (রা.)। বিভিন্ন সূত্র মতে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর জন্মের বছর কাবাঘর তথা মক্কা আক্রমণ করে তৎকালীন আবিসিনিয়া বর্তমান ইথিওপিয়া থেকে আগত প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য। এই সৈন্যদের অগ্রভাগে ছিল বিপুল সংখ্যক হাতি। অথচ মহান আল্লাহ মক্কা তথা কাবাঘর বাঁচাতে আবাবিল নামক এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র আকারের পাখি প্রেরণ করেন। অসংখ্য আবাবিল পাখি মহান আল্লাহর নির্দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরকণা হাতির ওপর নিক্ষেপ করে। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আবিসিনিয়ার বাহিনী এবং পরাজয়বরণ করে।

এ ঘটনা পবিত্র কোরআনের ১০৫ নং সূরা ফিলে বর্ণিত আছে। এই বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন আবিসিনিয়ার একটি গোত্রের রাজকুমারী হোমামা এবং তার স্বামী রাবাহ। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় তৎকালীন প্রথা মোতাবেক এই দম্পতিকে মক্কার কুরাইশদের দাসত্ব মেনে নিতে হয়। দাস-দাসী হিসেবে তাদের দুজনের ঠিকানা হয় কুরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খালফের ঘর।

কৃষ্ণাঙ্গ এই দম্পতির ঘরেই জন্ম নেন হযরত বেলাল (রা.) । দাস-দাসীর ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুদেরও তৎকালীন অমানবিক সামাজিক রীতি মোতাবেক বাবা-মাকে ক্রয় বা দখল করা মালিক বা প্রভুর দাসত্ব করতে হতো। তাই রাজকন্যার গর্ভজাত হয়েও জন্মসূত্রে হযরত বিলাল (রা.) উমাইয়া ইবনে খালফের দাসে পরিণত হন।

বিভিন্ন গ্রন্থ বিশেষত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনীগ্রন্থ এবং ইসলামের প্রথম দিকের ইতিহাস বইয়ে হযরত বিলাল (রা.)এর দৈহিক বর্ণনা পাওয়া যায়। এসব বর্ণনা মতে, কালো বর্ণের হযরত বিলাল (রা.) বেশ লম্বা এবং শক্তিশালী ছিলেন।

তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো এবং নাক ছিল চ্যাপ্টা। সেই সঙ্গে মোটা ঠোঁট এবং সাদা উজ্জ্বল চোখের অধিকারী ছিলেন হযরত বিলাল (রা.)। তার দুই চোয়াল ছিল পবিত্র দাড়িতে পরিপূর্ণ। কুরাইশরা তাকে ইবনে সাউদাবা কালো মহিলার ছেলে বলে ব্যঙ্গ করত।

তবে তাঁর কণ্ঠ ছিল অদ্বিতীয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত যে তিনি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর, ভরাট এবং মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন।

হযরত বিলাল (রা.) ক্রীতদাস বাবা-মায়ের সঙ্গে ক্রীতদাস হিসেবেই বেড়ে ওঠেন। তাদের মনিব বা প্রভু উমাইয়া ইবনে খালফ ছিলেন প্রভাবশালী কুরাইশ নেতা। এই উমাইয়ার ঘরেই গৃহকর্মীর কাজ করতেন হযরত বিলাল (রা.) এবং তার পরিবার। গৃহকর্মের পাশাপাশি দেব-দেবীতে পরিপূর্ণ কাবাঘর ও তার আশপাশের এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের কাজও করতে হতো তাদের। ৬১০ সালে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়তপ্রাপ্ত হন এবং মক্কাবাসীকে দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানান। কিন্তু বংশানুক্রমিকভাবে মূর্তিপূজায় অভ্যস্ত এবং দেব-দেবীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের কারণে অহঙ্কারী হওয়া কুরাইশগণ কিছুতেই দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে নিরাকার আল্লাহর আনুগত্য স্বীকারে সম্মত ছিল না। ফলে তারা ইসলাম গ্রহণের বদলে ইসলাম প্রচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে তারা নিজেদের বংশের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র ইসলাম প্রচারের কারণে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার পরিকল্পনা করে। এমনি এক প্রতিকূল পরিবেশে অতি গোপনে যে কয়েকজন মহান নারী-পুরুষ ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণ করে অমর হয়ে আছেন, হযরত বিলাল (রা.) তাদেরই একজন। মূর্তিপূজার আবহে বেড়ে উঠলেও হযরত বিলাল (রা.) ইসলামের মর্মবাণী ও একাত্মবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্রতিকূল পরিবেশ থাকায় গোপনে ইসলাম গ্রহণ করে ওয়াহেদঅর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর একাত্মতা উচ্চারণ করতে থাকেন। তাঁর এই একাত্মবাদের আরাধনা এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার তথ্য বেশি দিন গোপন থাকেনি। তাঁর মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে প্রতি উত্তরে তিনি শুধু একটি কথাই বলেন; তা হলো আহাদযার অর্থ আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। কুরাইশদের চোখে একজন ক্রীতদাস হিসেবে হযরত বিলাল (রা.) এর এই আচরণ ছিল চরম ধৃষ্টতা এবং তাদের শত বছরের বিশ্বাস, চিন্তা, চেতনা, আভিজাত্য ও মূল্যবোধের প্রতি চরম আঘাত। ফলে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি উমাইয়া। প্রথমত মুখের ভাষায় হযরত বিলাল (রা.) কে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার কথা বলা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। ফলে নির্মম অত্যাচারের পথ বেছে নেয় উমাইয়া ও তার দোসর কুরাইশরা। তবে সে অত্যাচারের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর।

হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তার বর্ণনা আজও মানুষকে আতঙ্কিত করে। প্রথম দিকে হযরত বিলাল (রা.) কে বেঁধে চাবুক ও লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। পালাক্রমে চলত এই লাঠিপেটা ও চাবুকাঘাত। পরবর্তীতে তাকে দিনে মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে খালি গায়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শোয়ানো হতো এবং বুকের ওপর গরম ও ভারী পাথর দেওয়া হতো। গরমে তার চামড়া, গোশত, চর্বি পুড়ে হাড় বের হয়ে গিয়েছিল। ক্রমাগত অত্যাচারে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। আবার জ্ঞান ফিরলেই তিনি বলতেন- আহাদঅর্থাৎ আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। আর এই একটি শব্দ উচ্চারণ বন্ধ করার বিনিময়ে সব নির্যাতন বন্ধ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমনকি প্রকাশ্যে উচ্চারণ না করে গোপনে বা মনে মনে উচ্চারণের পরামর্শও দেন কেউ কেউ। অথচ ইমানের শক্তিতে বলীয়ান অকুতোভয় হযরত বিলাল (রা.) এর মুখে শত বাধার মুখেও উচ্চারিত হয় একটি শব্দ আহাদআল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়।

হযরত বিলাল (রা.)এর ওপর এই নির্মম অত্যাচারের খবর জানতে পেরে মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.) কে যে কোনো মূল্যে হযরত বিলাল (রা.) কে তাঁর মনিব উমাইয়া থেকে ক্রয় এবং দাসত্ব থেকে মুক্ত করার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মোতাবেক হযরত আবু বকর (রা.) একজন শক্ত-সামর্থ্য ক্রীতদাসের বিনিময়ে মতান্তরে অর্থের বিনিময়ে হযরত বিলাল (রা.) কে ক্রয় করেন এবং চিরতরে মুক্ত করে দেন। সেই থেকে তিনি আমৃত্যু ইসলামের পক্ষে কাজ করে গেছেন। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)এর একান্ত সঙ্গী।

মহানবী (সা.) এর জীবদ্দশায় নির্মিত প্রথম মসজিদ হলো মসজিদ আল কুবাযা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় পথিমধ্যে কুবা নামক স্থানে নির্মিত হয়। পরবর্তীতে নির্মিত হয় মদিনায় অবস্থিত ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ মসজিদ আল নববীবা নবীর মসজিদ। উভয় মসজিদ নির্মাণের সময়ই হযরত বিলাল (রা.) সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তবে ঠিক কখন এবং কীভাবে মসজিদে আজানের প্রচলন হয় তা নিয়ে দুই রকম তথ্য রয়েছে। সুন্নি মতানুসারে এবং সুদান আবু দাউদ ৪৯৯নং হাদিস মোতাবেক হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অন্যতম সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়াদ এক রাতে স্বপ্নযোগে আজানের বিষয়টি অবগত হন। লোক মারফত এই তথ্য মহানবী (সা.) পর্যন্ত পৌঁছলে তিনি তা গ্রহণ করেন। ইবনে জায়াদকে তা হযরত বিলাল (রা.) কে শিখাতে বলেন এবং আজানের প্রচলন করেন। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় গির্জায় ঘণ্টা বাজিয়ে প্রার্থনার জন্য ডাক দিত। তার বদলে মহানবী (সা.) আজানের মধুর বাণীকে শ্রেয়তম মনে করতেন। অন্যদিকে শিয়া মতানুসারে, আজানের প্রচলন হয়েছে স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশে, তবে আজানের প্রচলন বা উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ থাকলেও এই বিষয়ে সবাই একমত যে, পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম আজান দেওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন হযরত বিলাল (রা.)। ভরাট, আবেগঘন, সুরেলা ও মিষ্টি কণ্ঠস্বরের জন্য হযরত বিলাল (রা.) কে আজান প্রদানের দায়িত্ব দেন মহানবী (সা.)। তাঁর আজান শুনে শুধু মানুষ নয়, জিন এমনকি পশু-পাখিরাও মুগ্ধ হতো বলে ধারণা করা হয়। মদিনাবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন হযরত বিলাল (রা.) এর আজান শোনার জন্য।

অনেকেরই ধারণা ছিল হযরত বিলাল (রা.) ফজরের আজান না দিলে পৃথিবীত সূর্য উদিত হবে না এবং সবাই চিরতরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তৎকালে মদিনায় ঘড়ির প্রচলন ছিল না, তথাপি হযরত বিলাল (রা.) সঠিক সময়ে আজান দিতে পারতেন। সাধারণত তিনি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে আজান দিতেন। মদিনার পার্শ্ববর্তী স্থানে এক মহিলার বাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আজান দিতেন বলেও তথ্য পাওয়া যায়।

সুনান আবু দাউদ হাদিস সংকলনের ২নং বইয়ের ৫১৯ নং হাদিস মোতাবেক উরাওয়াহ ইবনে আজ জুবায়ের মদিনাবাসী বানু আন নাজির গোত্রের ওই মহিলার উদ্ধৃতিতে বলেন যে, হযরত বিলাল (রা.) সকাল হওয়ার আগেই ওই বাড়ির ছাদে চলে আসতেন এবং ফজরের আজানের সময়ের অপেক্ষা করতেন। তারপর ফজর নামাজের আজান দেওয়ার সময় হলে প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করতেন এবং কুরাইশরা যেন ইসলামের পথে চলে আসেন, এ জন্য দোয়া করতেন। প্রতিদিন এমন দোয়া করেই তিনি ফজরের আজান দিতেন। যুদ্ধ এবং ভ্রমণের সময়ও মহানবী (সা.) এর সঙ্গী হতেন হযরত বিলাল (রা.) এবং যথা সময়ে তিনি আজান দিতেন। ৬২৯ সালের শেষ এবং ৬৩০ সালের শুরুতে এর নেতৃত্বে মদিনা থেকে আগত মুসলমান বাহিনী মক্কা নগরী বিশেষত কাবাঘর দখল করে। কাবাঘর দখল সম্পন্ন হওয়ার পর পর মহানবী (সা.) এর নির্দেশে হযরত বিলাল (রা.) কাবাঘরের ওপর ওঠেন এবং উচ্চৈঃস্বরে আজান দেন। এই আজান শুনে ইসলামে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলে মহানবী (সা.) ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার কথাও তাঁরা হযরত বিলাল (রা.) এর দরাজ কণ্ঠে শুনতে পান এবং দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে শামিল হন।

মক্কা থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ সালে মদিনায় হিজরত করেন। মহানবী (সা.) একান্ত ভক্ত ও অনুগত হযরত বিলাল (রা.)ও তাঁকে অনুসরণ করে মদিনায় গমন করেন এবং মহানবী (সা.) এর নির্দেশে ইসলামের স্বার্থে মনপ্রাণ উজাড় করে নানামুখী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। হিজরি দ্বিতীয় সালে (৬২৪ সাল) মহানবী (সা.) এর অনুগত মদিনা বাহিনীর সঙ্গে মক্কা থেকে আগত কুরাইশ বাহিনীর যুদ্ধ হয়। বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধ রমজান মাসের ১৭ তারিখে হজরত বিলাল (রা.) এর জন্মভূমি হিজাজের বদর নামক এক শহরে সংঘটিত হয়। শত্রুপক্ষের প্রায় ১ হাজার পদাতিক সৈন্য, ১০০ ঘোড়া আর ১৭০টি উটের বিপরীতে মুসলমানদের ছিল প্রায় ৩০০ পদাতিক সৈন্য, ২টি মাত্র ঘোড়া এবং ৭০টি উট। তবে পরম সাহসিকতা ও বীরত্বের মধ্য দিয়ে এই অসম যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয়ী হন।

কাকতালীয়ভাবে এই যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষে ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফ, যার ক্রীতদাস ছিলেন হযরত বিলাল (রা.)। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য হজরত বিলাল (রা.) এর ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালালেও বদরের যুদ্ধে উমাইয়া ইবনে খালফ নতজানু হয়ে হযরত বিলাল (রা.) এর কাছে জীবন ভিক্ষা চাইতে থাকেন। সহিহ বুখারি শরিফের তৃতীয় খন্ডের ৩৮নং বইয়ের ৪৯৮ নং হাদিসের আলোকে জানা যায়, উমাইয়া ইবলে খালফের বন্ধু ছিলেন মুসলমানদের পক্ষে লড়াই করা আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.)। বদরের যুদ্ধের সময় রাতের বেলা মুসলমানগণ ঘুমিয়ে পড়লে আবদুর রহমান (রা.) তাঁর বন্ধু উমাইয়ার কথা ভেবে পাহাড়ের ওপরে ওঠেন, যা হযরত বিলাল (রা.) বুঝতে পারেন।

ফলে তিনিও মুসলমান কিছু মদিনাবাসী সৈন্য নিয়ে পাহাড়ে ওঠেন। পথে উমাইয়ার পুত্র তাদের ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করলে আনসারগণ তাকে হত্যা করে। পরে হযরত বিলাল (রা.) পাহাড়ের ওপরে উঠলে তিনি তার প্রাক্তন মনিব এবং কোরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খালফকে দেখতে পান। এ সময় উমাইয়া নতজানু হয়ে আবদুর রহমান (রা.) এর শরীরের নিচে লুকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই অবস্থায় তরবারির আঘাতে মৃত্যু ঘটে উমাইয়া ইবনে খালফের। এভাবেই এক সময়কার ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রা.) এর হাতে প্রাণ হারান তাঁর প্রতি অমানবিক নির্যাতনকারী প্রাক্তন প্রভু উমাইয়া ইবনে খালফ। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে হযরত মুহাম্মদ (সা.), হযরত হামজা (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) এর পরই হযরত বিলাল (রা.) কে একটি অংশের নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি যথাযথভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেন এবং সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে শত্রু শিবিরে ত্রাস ছড়িয়ে দেন।

৬১০ সালে মহানবী (সা.) নবুওয়তপ্রাপ্ত হন এবং এক আল্লাহর পথে সবাইকে ডাক দেন। কুরাইশদের তীব্র বিরোধিতায় তখন মক্কায় ইসলাম প্রচার এমনকি বসবাস করাও মুসলমানদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। ফলে তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ৬১৩ সালে মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গী এবং নব মুসলিমদের বর্তমানে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া নামক দেশের ভূখন্ডে হিজরতের পরামর্শ দেন। এ সময় হজরত বিলাল (রা.) কে হিজরতের পরামর্শ দেওয়া হলেও তিনি মহানবী (সা.) কে ছেড়ে কিছুতেই হিজরতে যাননি। বরং ইসলাম ও মহানবী (সা.) এর নিরাপত্তায় নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুতি নেন। পরবর্তীতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ সালে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। তাঁকে অনুসরণ করে হযরত বিলাল (রা.)ও মদিনায় গমন করেন এবং মহানবী (সা.) এর সার্বক্ষণিক সঙ্গীদের একজন হয়ে ওঠেন।

হযরত বিলাল (রা.) ছিলেন সব ধরনের লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। মক্কাবিজয়ের পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নির্দেশে কুরাইশদের কাছ থেকে কাবাঘরের চাবি বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয় হযরত বিলাল (রা.) এর ওপর। তিনি কাবাঘরের চাবি সংগ্রহ করেন এবং কাবাঘর খুলে সেখানে স্থাপিত দেব-দেবীর মূর্তি অপসারণ এবং দেয়ালে আঁকা দেব-দেবীর ছবি মুছে জমজম কূপের পানি দিয়ে কাবাঘর ধোয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর তাঁর আজানে কাবাঘরে নামাজ আদায় শুরু হয়। এর আগে ও পরে মদিনায় অবস্থানকালেও ইসলাম প্রচার ও প্রসার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য সংগৃহীত সব সম্পদের সংরক্ষক ছিলেন হযরত বিলাল (রা.)। সুনান আবু দাউদ গ্রন্থের ২নং বইয়ের ১১৫৯নং হাদিসসহ আরও বেশ কিছু হাদিসে দেখা যায় ঈদের নামাজ শেষে হযরত বিলাল (রা.)কে সঙ্গে নিয়ে মহিলাদের কাছে যেতেন এবং ইসলাম ও গরিবদের জন্য দান করার আহ্বান জানাতেন। এরপর হযরত বিলাল (রা.) তাঁর শরীরে জড়ানো বিশেষ কাপড় বিছিয়ে দিতেন এবং মহিলারা সেখানে সাধ্যমতো টাকা-পয়সা অলঙ্কার ইত্যাদি দান করতেন। হযরত বিলাল (রা.) বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা সংরক্ষণ করতেন এবং মহানবী (সা.) এর নির্দেশে তা ব্যয় করতেন। মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গী, সৈন্যবাহিনী কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রসহ যেখান থেকে যা কিছুই পাওয়া যেত, তা হযরত বিলাল (রা.) এর তত্ত্বাবধানে থাকত। এমনকি কিছু খেজুর বা সামান্য দুধ এলেও তা হযরত বিলাল (রা.) গ্রহণ করতেন এবং তিনিই মহানবী (সা.) এর নির্দেশে তা বণ্টন করতেন। সহিহ বুখারি শরিফের তৃতীয় খন্ডের ৩৮নং বইয়ের ৫০৪নং হাদিসে এ-সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে।

ইসলামের ঊষালগ্নে শত প্রতিকূলতার মাঝেও মহান আল্লাহর প্রতি ইমান এনে এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে আল্লাহ প্রেরিত রসুল মেনে মূর্তিপূজা ছেড়ে মুসলমান হয়েছিলেন, হযরত বিলাল (রা.) ছিলেন তাদেরই একজন। মহানবী (সা.) এর সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্যও জোটে তাঁর কপালে। শুধু তাই নয়, তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল যে, তিনি মহানবী (সা.) কে কাছে থেকে দেখেছেন, একসঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করেছেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন, কখনো একই সঙ্গে অভুক্ত ছিলেন আবার কখনো সামান্য খাবার বা পানীয় ভাগ করে খেয়েছেন। তাই হযরত বেলাল (রা.) এর মনপ্রাণে সর্বক্ষণ রসুল (সা.) এর ছায়া এবং আদর্শ বিরাজ করত। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে সবার প্রাণপ্রিয় রসুল (সা.) পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, তা ভাবতেও পারেননি হযরত বিলাল (রা.)। তাই ৬৩২ সালের ৮ জুন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওফাত হলে শোকে দিশাহারা হয়ে পড়েন হযরত বিলাল (রা.)। প্রিয় নবী (সা.) এর স্মৃতিবিজড়িত প্রতিটি স্থান তাঁকে এমন শোকাতুর করে তোলে যে, তার পক্ষে মহানবী (সা.) বিহীন মদিনায় অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মহানবী (সা.) এর মৃত্যুর পর হযরত বিলাল (রা.) এর পক্ষে আজান দেওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি শত অনুরোধেও মদিনায় আর আজান দিতে পারেননি। তবে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য মতে, মহানবী (সা.) এর কন্যা মা ফাতেমা (রা.) এর অনুরোধে একবার এবং মহানবী (সা.) দৌহিত্র ইমাম হাসান (রা.) এবং ইমাম হোসেন (রা.) অনুরোধে অরেকবার আজান দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান। মদিনাবাসী এই আজান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। তাই আজান শুরু হওয়া মাত্র একদিকে আবেগ আবার অন্যদিকে মহানবী (সা.) এর অনুপস্থিতির কারণে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন মদিনাবাসী। অনেকের মতে, হযরত বিলাল (রা.) এসব ক্ষেত্রে আজান শেষ করতে পারেননি। আজানের মধ্যভাগে রসুলুল্লাহশব্দ উচ্চারণের পরপরই তিনি জ্ঞান হারান। এই সময় মহানবী (সা.) এর সঙ্গে তাঁর সব স্মৃতি, বিশেষত ইসলাম প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর বিভিন্ন অত্যাচার সহ্য করার করুণ চিত্র তাঁর মানসপটে ভেসে উঠত। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিনি মদিনা ছেড়ে সিরিয়ার দামেস্কে চলে যান। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব এ সময় দামেস্কে যান। তিনি হজরত বিলাল (রা.) কে আজান দেওয়ার অনুরোধ করলে তা ফেলতে পারেননি। সম্ভবত এটিই ছিল পৃথিবীর বুকে প্রথম এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মুয়াজ্জিনের শেষ আজান। এই দামেস্ক শহরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশের মতে ৬৪০ সালের ২ মার্চ তাঁর মৃত্যু ঘটে। অন্যদের মতে ৬৩৮ থেকে ৫৪২ সালের মধ্যে তার মৃত্যু ঘটে। জীবনের শেষ দিকে তাঁর স্ত্রী যখন শোকসাগরে ভাসছিলেন, তখন হযরত বিলাল (রা.) তৃপ্তি নিয়ে তাঁর প্রিয় নবী (সা.) এর সান্নিধ্যে পরলোকে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। মৃত্যুর পর দামেস্কের বাব আল সাগির সমাধিতে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। সিরিয়ার অন্যান্য কিছু অঞ্চলে এবং পৃথিবীর অন্য দেশেও তাঁর কবর রয়েছে বলে স্থানীয় মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন। এর মধ্যে জর্ডানের আম্মান শহরে হযরত বিলাল (রা.) এর নাম উদ্ধৃত করে একটি গম্বুজসহ সৌধ রয়েছে।

তফসিরবিদদের মতে, হযরত বিলাল (রা.) এর প্রতি ইঙ্গিত করে বেশ কিছু আয়াত নাজিল হয়েছে। যেমন-

আর যে কেউ আল্লাহ ও রসুলের অনুসরণ করবে সে তাদের সঙ্গী হবে যাদের আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন- যেমন নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী’( সূরা নিসা আয়াত ৬৯)।

হে বিশ্বাসীগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারীর চেয়ে ভালো হতে পারে; আর কোনো নারীও অপর নারীকে যেন উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণীর চেয়ে ভালো হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না। আর তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা খারাপ কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত হয় না তারা তো সীমালঙ্ঘনকারী।

 চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com

 follow our Facebook page DHAKA Voice

follow our Twitter account Dhaka Voice 

No comments

Powered by Blogger.