যশোর রোডের ভালোবাসায়...
যশোর রোড; শুধুমাত্র একটি রাস্তা নয়। একটি আবেগের নাম, একটি ভালোবাসার নাম। একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের নাম! যশোর থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল-বনগাঁ-হাবড়া-বারাসাত পার হয়ে কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ১২৫ কিলোমিটারের এ সড়কের মাত্র ৩৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তবে আবেগ, ভালোবাসা আর বিশ্বজুড়ে এর পরিচিতির সঙ্গে বাংলাদেশ নামটাই বেশি জড়িত।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে যশোর রোডের নাম। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য এই যশোর রোড পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। খাদ্য-পানির অভাবে পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল শত শত মানুষ। কবি অ্যালেন্স গিন্সবার্গ এই সড়ক দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সময় এসেছিলেন বাংলাদেশে। পথে শরণার্থীদের দুর্দশা দেখে তিনি লিখেছিলেন সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। তার এ কবিতা মুক্তিযুদ্ধের করুণ চিত্র বিশ্বজুড়ে ছড়াতে রেখেছিল বিশেষ ভূমিকা। ঐতিহাসিক এ মহাসড়কের পাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো শতবর্ষী বৃক্ষ।
কিন্তু কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক এ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ ঐতিহাসিক বৃক্ষরাজি কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে তা আটকে যায়। সবশেষ ২০১৮ সালে এ নিয়ে হাইকোর্টে রিটও হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গাছ কাটা নিয়ে স্থিতাবস্থা রয়েছে এবং সেটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গাছ কাটা যাবে না।
শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প
পশ্চিমবঙ্গ অংশেও ছিল আদালতের একই ধরনের নির্দেশনা। বনগাঁ শহরের ১ নম্বর রেলগেটে যানজট কমাতে রেলওয়ে উড়ালপুল তৈরির পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। এই জন্য বারাসাত থেকে বনগাঁ পর্যন্ত যশোর রোড ধারে মোট ৩০৫টি প্রাচীন গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারতের জাতীয় সড়ক কর্র্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের জেরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা হয়েছিল। ২০১৮ সালে গাছ কাটার স্থগিতাদেশ দিয়েছিল দেশটির আদালত। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে আদালত জানিয়েছে, ৩০৫টি গাছ কাটার আগে ১৫০০টি গাছ লাগাতে হবে জাতীয় সড়ক কর্র্তৃপক্ষকে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা ফের সরব হয়েছেন। আবারও আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। ঘোষণা করেছেন কর্মসূচিও। আগামী ২৫ মার্চ তারা কলকাতা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করবেন, ধর্মতলার মোড়ে লেনিন মূর্তির পাদদেশে করবেন মানববন্ধন।
যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এসব কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ী। গতকাল বুধবার নিজেরে ফেসবুকে এক পোস্টে এ আহ্বান জানান তিনি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী এ শিল্পীর এমন পোস্ট নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। গতকাল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার পোস্টে হাজারো মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। শত শত মানুষ শেয়ার করেছেন তার আহ্বান। পোস্টের নিচে মন্তব্যের ঘরে কেউ তার সঙ্গে সংহতি জানাচ্ছেন কেউবা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সমালোচনা করেছেন। তবে তিনি যৌক্তিক কথায় সে সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, যশোর রোড নিয়ে নিজের আবেগ আর প্রয়োজনের কথা। আর যারা সংহতি জানিয়েছেন তাদেরও বিনয়ের সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন শান্তিনিকেতনের সাবেক এক শিক্ষার্থী। বলেন, গাছের প্রতি প্রেম তার সেই শান্তিনিকেতনের শৈশব-কৈশোর থেকেই জন্মেছে। প্রকৃতির প্রেম পেয়েছেন কবিগুরুর দর্শন থেকেই।
সুমিত পাত্র নামের একজন লিখেছেন, বিকল্প পথ বাতলে দিন, কোন পথে নতুন চওড়া রাস্তা বানানো হলে কলকাতা-পেট্রাপোল যোগাযোগ দ্রুত করা সম্ভব। কারণ যশোর রোড অধিকাংশ জায়গায় অত্যন্ত সংকীর্ণ ফলে যানজট আর দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, ফলে রাস্তা চওড়া করা অতীব আবশ্যক। আর অবশ্যই ইন্টারন্যাশনাল করিডর হিসেবে এই রাস্তার গুরুত্ব অপরিসীম, পণ্যবাহী ট্রাক থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী পরিবহন সবাইকেই সঠিকভাবে দ্রুত পরিষেবা প্রদানকারী জাতীয় সড়কের ব্যবস্থা করার অত্যন্ত জরুরি। আমার এই বক্তব্যগুলোর ভিত্তিতে আপনার কাছে প্রশ্ন রইল কী বিকল্প নকশা প্রস্তুত আছে আপনার কাছে? তারপর না-হয় হাজার রকমের বন্ধন করে নেবেন।’
তার এমন মন্তব্যের জবাব সাহানা তিনটি পয়েন্টে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, প্রথমত আমার বাংলাদেশ যাতায়াতে আমি কোনোদিনই আকাশপথে যাইনি- এই রাস্তা ধরে সোনালি/সোহাগ পরিবহনের বাসে যাতায়াত করেছি। বহু বছর। এই রাস্তা ও তার উপযোগিতা আমার অজানা নয় বুঝতেই পারছেন। এই গাছগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমার অনেকগুলো জার্নির সাক্ষী।
দুই নম্বর পয়েন্ট হিসেবে সাহানা লিখেছেন, যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই বিকল্প রাস্তার কথা ভেবেই আন্দোলনে নেমেছেন। প্রশ্নটি তাদের করবেন। আমি রোড ইঞ্জিনিয়ার নই যে নীল নকশা বানাব। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছি মাত্র কারণ আমি গাছ কেটে রাস্তা/রেলসেতু/ফ্লাইওভার বানানোর বিপক্ষে।
তৃতীয় পয়েন্টে তিনি সুমিত পাত্রের মন্তব্যকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আপনার প্রশ্নগুলো যথোচিত, কিন্তু আপনি যেভাবে আমাকে পার্সোনালি অ্যাটাক করলেন, তাতে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনি শুধুমাত্র ৩৫৬টি গাছ কেটে ফেলার সপক্ষে নন। এর বাইরেও কোনো কারণ আছে।
ইতিহাস বলছে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যশোর শহরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ পোদ্দার। সেই সময় যশোর থেকে বহু হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতা যেতেন। একবার নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার কারণে জমিদারের মা গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে অনশনে বসেন। মা শর্ত দেন, গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। পুত্র কালী প্রসাদ মায়ের দাবি মেনে রাস্তা নির্মাণ করেন। তখন এই সড়কের পাশে বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রচুর গাছ লাগানো হয়। সেই গাছই আজ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যশোর রোডজুড়ে।
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments