কুকিদের স্বপ্নভঙ্গ
‘নো ফুল স্টেট, নো রেস্ট’। কথিত ‘কুকিল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার নামে এমন স্লোগান দিয়েছিল কুকি জাতিগোষ্ঠীর বম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ)’ উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের পর কথিত কুকিল্যান্ডের সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। কেএনএফের সশস্ত্র শাখা ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’ পার্বত্য এলাকায় যেসব আস্তানা গেড়েছিল সেগুলোর সবই এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে সশস্ত্র তৎপরতার শক্তি ও সুযোগ হারিয়ে কুকি সন্ত্রাসীরা এখন বিচ্ছিন্নভাবে চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
সম্প্রতি এমন বেশ কিছু অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনার সঙ্গে কেএনএফ বা কেএনএর সম্পৃক্ততা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কেএনএফ বা কেএনএ ছাড়াও পার্বত্য তিন জেলায় চাঁদাবাজির আধিপত্য নিয়ে জেএসএস, ইউপিডিএফসহ অন্য আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলোও বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, পার্বত্য তিন জেলায় জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসীত), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), কেএনএফ এবং মগ পার্টি বা এমএনপির সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অপতৎপরতায় অশান্ত ও ভীতিকর হয়ে উঠছে পাহাড়ি জনপদ। বান্দরবানকেন্দ্রিক আলোচিত সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সন্ত্রাসী তৎপরতা বর্তমানে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়লেও বেশ তৎপর জেএসএস (মূল) ও ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সশস্ত্র শাখা। যদিও এসব সংগঠন বরাবর সশস্ত্র তৎপরতার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু বাস্তবে উপজাতি এসব সংগঠনের চাঁদাবাজি-আধিপত্য বিস্তারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা পাহাড়ি বাসিন্দাদের কাছে অনেকটা স্পষ্ট। যেমন, গত কয়েক দিনের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ঘটে গেছে বেশ কটি গুম, খুন, অপহরণসহ পাল্টাপাল্টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা। এসব ঘটনায় অভ্যন্তরীণ হানাহানির পাশাপাশি জুলুম-চাঁদাবাজি স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে।
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, ‘চাঁদাবাজি, অপহরণসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কেএনএফ বা জেএসএস ও ইউপিডিএফসহ পার্বত্য অঞ্চলের এ ধরনের সব আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একই ধরনের। মুখে এরা রাজনৈতিক আদর্শের কথা বললেও মূল লক্ষ্য চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ রাখতে তারা এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক আধিপত্য বা প্রভাব বিস্তার করে। এ নিয়েই মূলত দীর্ঘদিন ধরে গোলাগুলি বা হানাহানির ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করে চাঁদা দিতে বাধ্য করছে তারা। এ পরিস্থিতিতে দীর্ঘস্থায়ী শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করতে ভুক্তভোগী পাহাড়ি জনগণকে এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমুখী চেতনা গড়তে হবে। পাহাড়ি বাসিন্দারা ভয়ে হোক বা যেকোনো কারণে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও আরও বেশি করে ভুক্তভোগীদের সাহস ও ভরসার জায়গায় যেতে হবে। সার্বিকভাবে এমন পরিবেশ তৈরি করা গেলে পার্বত্য অঞ্চলের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো হারিয়ে যাবে।
স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে-সবুজে ঘেরা দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দিন দিন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে। পাহাড়ের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত চলছে অস্ত্রের মহড়া। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, বন্দুকযুদ্ধ এবং হরহামেশায় প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। সরকার তথা পার্বত্য অঞ্চলে নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নানা উদ্যোগ নিলেও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র শাখার তৎপরতায় পার্বত্য জেলাগুলো (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) প্রায় অশান্ত থাকছে। গত কয়েক দিন ধরে পার্বত্য তিন জেলায় একের পর এক সংঘাত ও হানাহানির ঘটনা ঘটছে।
যা ঘটছে পার্বত্য অঞ্চলে : জানা যায়, রাঙামাটির রাজস্থলীর বাঙ্গালহালিয়া ইউপির দুর্গম খুধুমছড়ায় গত শনিবার সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও মগ পার্টি নামে সমধিক পরিচিত মারমা ন্যাশনাল পার্টির (এমএনপি) মধ্যে প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। তার আগে গত ১৪ জানুয়ারি বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উহ্লা মং মারমাকে অপহরণের ৪ ঘণ্টা পর মুক্তি দেয় সন্ত্রাসীরা। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, কেএনএফ সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এদিকে রাঙামাটির কাউখালী থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী তিনজন নৌকা সমর্থককে অপহরণ করা হয়। সেনা অভিযানে তাদের মুক্তি মেলে। এ ছাড়াও গত ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে রাঙামাটির পর্যটন এলাকা সাজেক ভ্যালিতে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীরা পর্যটকবাহী একটি গাড়িতে গুলি চালায় এবং সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা ভাঙচুর করে। গত ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও ইপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুই গ্রুপের মুখোমুখি সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফের (প্রসীত) সহযোগী সংগঠনের চারজন নেতাকর্মী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় প্রতিপক্ষের হাতে তিনজন অপহৃত হয়। বলতে গেলে অনেকটা ‘রুটিন’ রেওয়াজের মতো তিন জেলার কোথাও না কোথাও সপ্তাহের ব্যবধানে হামলা, পাল্টা হামলা, গুম, খুন, গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। যার নেপথ্যের মূলে পার্বত্য অঞ্চলের হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। এর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত সংশ্লিষ্টরা।
যা বলছেন স্থানীয় ও সংশ্লিষ্টরা : নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, পাহাড়ে হাজার কোটি টাকার চাঁদা বাণিজ্য গড়ে তুলেছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এসব সংগঠনের নেপথ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি চক্র। কারণ, সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে অস্ত্র-সরঞ্জাম কেনাবেচায় এসব চক্র সম্পৃক্ত। এ ছাড়া তদারকির আওতামুক্ত কিছু এনজিও পরোক্ষভাবে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
স্থানীয়রা আরও বলছেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি, দীঘিনালা, মহালছড়ি, মানিকছড়ি লক্ষ্মীছড়ি ও গুইমারা উপজেলা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচর, বরকল, জুরাছড়ি, রাজস্থলী, কাউখালী, বাঘাইছড়ি, লংগদু, বিলাইছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলা, বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা, থানচি, নাইক্ষ্যাংছড়ি, লামা ও রোয়াংছড়ি উপজেলা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্গম এসব পাহাড়ি জনপদে চাঁদা ছাড়া কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্ভব নয়। অনেক সময় সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে অসাধু ঠিকাদাররাও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখে। এভাবে পাহাড়ের উন্নয়ন কাজের নামে আংশিক কাজ বা বিনা কাজে সরকারি টাকা লুটপাট হচ্ছে।
যা বলছেন তিন জেলার পুলিশ সুপার : এ প্রসঙ্গে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ সময়ের আলোকে বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধসহ জেলার সার্বিক নিরাপত্তায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এখন প্রযুক্তির সহায়তায় সবকিছু মনিটরিং করছি। জননিরাপত্তাই শেষ কথা।
একই প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, পর্যটকসহ জেলার সার্বিক নিরাপত্তায় আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি।
বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ কাজ করছে। বান্দরবান ট্যুরিস্ট এলাকা, সেই হিসেবে আমাদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হয়। নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই।
No comments