আত্রলিতা || সাদিয়া শাহরিণ শিফা || পর্ব : ১৫
উপন্যাস : আত্রলিতা
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ১৫
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ১৫
ড্রয়িংরুমে বসে আছে আহিল। পাঁচদিন পর সন্ধ্যা নাগাদ সে অহমকে পড়াতে এলো। এই কদিন কিভাবে কেটে গেছে টেরও পায়নি। রাস্তা থেকে আসার সময় ভাবতে ভাবতে এলো যে কি বলা যায়। নিশ্চয়ই তাকে জিজ্ঞেস করা হবে যে আসেনি কেন এতদিন? আত্রলিতা কেমন আছে? সে কি মুখ ভাড় করে কিছু জিজ্ঞেস করবে? তখন কি বলবে আহিল! আত্রলিতা অহমের বাবা বরাবর ই বেশ চুপচাপ। সে হয়তো কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তবুও জিজ্ঞেস করলে কি বলা যেতে পারে ঠিকঠাক কিছু ভেবে রাখা উচিত। তখন কি আহিল তার বাবার কথা বলবে? “বাবার কথা বললে টাকার কথাটাও কি তুলবো? যদি অল্প কিছুও ও সাহায্য পাওয়া যায়!” মনে মনে ভাবলো আহিল।
কিন্তু আত্রলিতাদের বাসার ড্রয়িংরুমে এসেই ওর সব চিন্তা উবে গেল। পুরো বাসা জুড়ে কেমন একটা ভার ভার ভাব। মুখ গোমড়া করে দরজা খুলে দিয়েছিল অহম। তারপরই দৌড়ে আত্রলিতার ঘরে গেল। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আহিল বুঝতে পারলো আত্রলিতার ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে, বেশ জোড়েই। সে কান পাততেই শুনতে পেল আত্রলিতার বাবার গলা,
“ ডাক্তার সাহেব আপনি যা করার করুন। যেভাবে পারেন আমার মেয়েটাকে সুস্থ করুন। যত টাকা লাগে আমি খরচ করতে রাজি। আমার মেয়েটা জীবনে কোনো সুখ পায়নি, ও জীবনে কিচ্ছু পায়নি...” বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন আব্দুর রহমান সাহেব। ডাক্তার সাহেব বললেন,” উহু। রোগীর সামনে বসে এভাবে কাঁদবেন না। নট অ্যালাউড। রোগীর এখন কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ চলছে। সবেমাত্র সে ঘুমিয়েছে। তার কড়া একটা ঘুম দরকার। ব্রেইন স্টাবেল হবে। চলুন অন্য রুমে চলুন। ওখানে বসে আলাপ করি।“
সব কথাই স্পষ্ট শুনতে পেল আহিল।
আব্দুর রহমান সাহেব এবং ডাক্তার সাহেব এসে আহিলের পাশেই সোফায় বসলো। অহম এখনও বোনের ঘর থেকে বেরোয়নি। হয়তো আজ সে তার স্যারের কাছে পড়বে না। আহিলের এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে বসে থাকাটা খুবই বিরক্তিকর লাগার কথা। তবে আশ্চর্যজনকভাবে তার একটুও অস্বস্তি হচ্ছে না। সে বসে মনোযোগ দিয়ে আব্দুর রহমান সাহেব এবং ডাক্তার সাহেবের মধ্যকার কথোপকথন শুনছে।
ডাক্তার সাহেব বলে উঠলেন,” দেখুন রহমান সাহেব, আপনার মেয়েকে সুস্থ করে তুলবার জন্য টাকা-পয়সা কোনো ফ্যাক্ট না। ইভেন, আমি বলবো, কোটি টাকা খরচ করেও ওকে সুস্থ করা সম্ভব নয়।”
-“তবে কি আর কোনো উপায় নেই” বলতে বলতে মাথা নিচু করে ফেললেন আব্দুর রহমান সাহেব। ভেঙে পড়লেন যেন।
-“উপায় একটা আছে অবশ্য..”
-“কি উপায়! ডাক্তার সাহেব? বলুন আমি সব করতে রাজি! আমার মেয়েটা ওর মায়ের বড্ড প্রিয় ছিল... ওর মা মারা পরই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে! আমি আমার মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে দেখতে পারছি না! বলুন ডাক্তার সাহেব, কি উপায়?”
-“ আসলে আপনার মেয়ের রোগটা হলো বাইপোলার ডিসঅর্ডার। আগেও আপনাকে বলেছি। কোনো কিছু নিয়ে বারবার প্রচন্ড শোকে এমন মানসিক সমস্যা হয়। আবার, প্রিয় মানুষ একে একে চলে গেলে অথবা কাছের মানুষের মৃত্যুতে বারবার মেন্টাল শক পেলে এই রোগ হতে পারে। আপনার মেয়ের সাথে কথা বলে, কাউন্সিলিং করে আমি যতটা বুঝেছি, ওর মেইন ভয় বলুন শোক অথবা শকের জায়গা ই বলুন, সেটা হলো ‘মৃত্যু’”
-”মানে?” এই প্রথম ডাক্তারের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আব্দুর রহমান সাহেব।
-“ মানে, সহজ কথায় যদি বলি, আপনার মেয়ে মাঝেমাঝেই যাদের দেখতে পায়, সেই মানুষগুলো মৃত। তার মধ্যে আপনার ওয়াইফ ও আছে।“
-“কি বলছেন!” হতভম্ব হয়ে গেলেন রহমান সাহেব।
-“ জ্বি ঠিক বলেছি রহমান সাহেব। আপনার মেয়ে প্রথম মানসিক শক পায় খুব ছোট বয়সে। যখন তার মন ও মস্তিষ্ক দুটোই কোমলমতি। হোস্টেলে তার খুব কাছের সহপাঠী যখন সুইসাইড করে..”
ডাক্তার সাহেবের কথাগুলো শুনতে শুনতে আব্দুর সাহেবের চোখদুটো বড় বড় হয়ে যেন বিস্ফারিত হয়ে বেরোবে। আহিলের মনে হচ্ছে তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে!
ডাক্তার সাহেব বলতে লাগলেন,“আপনার মেয়ে আমার সাথে কাউন্সিলিংয়ের এতগুলো দিন কখনো এসব কথা স্বীকার করেনি। সবসময় বলে গেছে যে, সে কল্পনায় কিছু মানুষ দেখতে পায়, বাস্তবে যাদের অস্তিত্ব নেই। আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছি চেনা কেউ অথবা অতীতের সাথে জড়িত কেউ কিনা। সে বলেনি। আজই প্রথম স্বীকার করলো। বললো যে, সে প্রায়ই তার মৃত মা এবং হোস্টেলের বেডমেট, কলেজ সহপাঠী, যারা দুজনেই মৃত তাদের দেখতে পায়। শুধু দেখতেই পায় না, ওর ধারণা, তারা এসে ওকে হার্ট করার চেষ্টা করে, মেরে ফেলতে চায় কখনও কখনও আশেপাশের মানুষের ক্ষতি এটা করার জন্য ওকে জোর করে। যে কারণে ও মাঝেমাঝেই খুব ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ে, চিৎকার চেঁচামেচি করে, আশেপাশে থাকা মানুষের ক্ষতি করে। আবার মাঝেমাঝে একেবারেই সুস্থ, শান্ত, চুপচাপ। সাইকোলজির ভাষায় বাইপোলার এক্টিভিটিস। এসব রোগী নিজের অজান্তেই মানুষের ক্ষতি করে ফেলে, পড়ে সজ্ঞানে ফিরলে খুব কষ্ট পায়, নিজের সাথে নিজে লড়াই করে, কাল্পনিক সেই মানুষগুলোর সাথে লড়াই করে। এককথায় বলতে পারেন, এসব রোগীর প্রতিটা সেকেন্ড খুবই স্ট্রাগল করে বাঁচতে হয়।”
ডাক্তার সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই শব্দ করে কেঁদে মুষড়ে পড়লেন আব্দুর রহমান সাহেব। আত্রলিতার এতটা কষ্টের কথা নাকি ষাটোর্ধ্ব এই বয়স্ক লোকের চোখের জল, কি দেখে যেন আহিলের চোখের কোণেও জল এলো। সন্তর্পণে মুছলো সে।
প্রায় মিনিট দুয়েক পর কোনোমতে আব্দুর রহমান সাহেব বললেন,“ আমি আমার মেয়েকে এত জিজ্ঞেস করেছি, কি হয়েছে মা, বল আমাকে, কেন তুই এমন করিস, ও কখনো আমাকে বলেনি। মেয়েটা আমার একলা এই মরণযন্ত্রণা ভোগ করেছে...”
ডাক্তার সাহেব চশমা মুছতে মুছতে বললেন,” এসব রোগীরা সচরাচর কাউকে নিজের সাথে কি হচ্ছে বিস্তারিত বলে না, তাদের ধারণা বললে ওই কাল্পনিক মানুষগুলো তাদের চরম ক্ষতি করবে। আপনার মেয়ে আপনাকে বা আমাকে, কাউকেই বলেনি কেন জানেন? ওর ধারণা ছিল, ও যে ওর মৃত মা আর সহপাঠীকে দেখতে পায় একথা আমাদের বললে ওরা ওকে মেরে ফেলবে। আর আজ কেন বললো জানেন? ও সাইকোলজিক্যালি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কোনোভাবে ও ভেবেছে ওর মৃত্যু একদম কাছে চলে এসেছে। ইনফ্যাক্ট ও বিশ্বাস করছে যে ও আর কয়েক ঘণ্টা অথবা কয়েক দিনের মধ্যে মারা যাবে। এই মাইন্ড স্টেট এর মধ্যেই সে যদি ওই কাল্পনিক মৃত চরিত্রগুলোকে আবার দেখতে পায় তাহলে হাই চান্স থাকে রোগীর সুইসাইড করার”
“ডাক্তার সাহেব আপনি থামুন” হু হু করে কেঁদে উঠলেন আব্দুর রহমান সাহেব,“ আপনি এসব কি বলছেন”
ডাক্তার সাহেব বেশ গম্ভীরভাবে বললেন,“ আমার কথা না, এটাই এই ধরনের পেশেন্টের সাইন। আর আপনার মেয়ে দীর্ঘ সময় বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছে! তার চিন্তাভাবনা এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে আপনার কিংবা আমার মতন নয়”
দুহাতের তালুতে কপাল চেপে কাঁদতে লাগলেন আব্দুর রহমান সাহেব। আহিল এই মুহূর্তে কথা বলতে বাধ্য হলো, বেশ জোরেই বলে উঠলো,“ ডাক্তার সাহেব আপনি এত কথা কেন বলছেন? দরকার নেই এত কথা বা পেশেন্ট হিস্টরি আমাদের জানার। আপনি দয়া করে কিউর বলুন। কি উপায়ে পেশেন্ট সুস্থ হবে সেটা বলুন, প্লিজ!”
“যেভাবেই হোক আপনি একটা কিছু করুন ডাক্তার সাহেব! আমার মেয়েটাকে কিভাবে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারি বলুন?”
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।
ডাক্তার সাহেব বললেন,“ দেখুন, এই ধরনের হোক, বা অন্য যে কোনো ধরনের মানসিক অসুস্থতার মূল কারণই কিন্তু হচ্ছে একাকীত্ব। আপনার মেয়ে একা একা থেকেছে, নিজের মস্তিষ্কের মধ্যে মৃত্যু, মৃত মানুষ- ব্যাপারগুলো নিয়ে হ্যালুসিনেট করেছে বলেই কিন্তু আজ ও এই পর্যায়ে এসেছে। ওর অবস্থা এতটা খারাপ হয়ে গেছে। মায়ের মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গতা ওর এই পরিস্থিতির জন্য নব্বই ভাগ দায়ী। ওর মনের মধ্যে অনেক কথা জমেছে, হা হুতাশ, দুঃখ শোক, অস্বস্তি জমেছে, কিন্তু ও কাউকে বলতে পারেনি। এই নিঃসঙ্গতাই মানুষকে মানসিক রোগী বানায়, বুঝলেন রহমান সাহেব!” আব্দুর রহমান সাহেব বাচ্চাদের মতন জোরে জোরে মাথা নাড়লেন। ডাক্তার সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন,” অসুখের কারণ যখন নিঃসঙ্গতা, তখন অসুখ সারাবে কোনো মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গ। আপনার মেয়েকে এমন কোনো মানুষের সান্নিধ্যে, ভালোবাসায় রাখতে হবে যার কাছে আপনার মেয়ে মন খুলে তার সবটুকু কথা শেয়ার করতে পারবে। এমন মানুষের সাথে তার থাকার সুযোগ করে দিন যে তাকে বুঝবে, তার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং তাকে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। আমার ওষুধগুলোর পাশাপাশি এটা খুবই দরকার। আপনার মেয়ের জন্য অত্যাবশ্যক।”
আব্দুর রহমান সাহেব ভাবনায় হারিয়ে গেলেন,“এমন মানুষ কে হবে? কোথায় পাবো!” ফ্লোরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সে ভাবনায় ডুবলেন।
“আজ উঠি। ইমার্জেন্সি হলে কল দিবেন।” ডাক্তার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে হেঁটে মেইন দরজা পর্যন্ত গেলেন। রোবটের মত পেছনে পেছনে গেলেন আব্দুর রহমান সাহেব। ঠিক দরজা দিয়ে বেরোবার সময় ডাক্তার সাহেব বলে উঠলেন,“ আব্দুর রহমান সাহেব, আপনি পারলে আত্রলিতাকে বিয়ে দিন।”
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments