বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
বঙ্গবন্ধু যেদিন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে দেশে ফেরেন,টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া,রূপসা থেকে পাথুরিয়ার মানুষগুলো সেদিন খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল।ততদিনে সারা পৃথিবী দেখেছে বাঙ্গালী জাতির মহান কৃতি। সুদীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র।যুদ্ধকালীন সময়ে সুদীর্ঘ নয় মাস তিনি ছিলেন পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে। ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারী সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক । বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন।
ভাষা আন্দোলন,যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,শিক্ষা আন্দোলন,ছয় দফা আন্দোলন গন অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন ইত্যাদী আন্দোলন সংগ্রামগুলো বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতাদের কাতারে পৌঁছে দেয়।তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশ্বনেতা হওয়ার চুড়ান্ত পর্যায়।
সেদিন বীরদর্পে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন-‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই গোপনে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।এর আগে সংগঠিত ১৯৪৭ সালের পরবর্তী আন্দোলনগুলোও তাদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে।
শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত বাঙালি নিধনযজ্ঞের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন শুরু করে।২৫ মার্চের সেই কাল রাতে লাখ লাখ নিরীহ বাঙালি জনগণের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা চালায় তারা। এ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করার জন্য উদাত্ত আহবান জানান।৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকে বাঙ্গালী জাতি আগে থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে মুক্তির একটাই উপায় বাঙ্গালী জাতির সামনে উন্মুক্ত আছে সেটা হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে আটক রাখেন। এ কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটে বঙ্গবন্ধুর নয় মাস ১৪ দিনের কঠিন কারাজীবন। কারাগারে বন্দী করা হলেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার নামেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে, ঠিক তখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কারাগারের যে সেলে তাকে রাখা হয়েছিল, সেই সেলের পাশে কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা, মুক্তির প্রশ্নে ফাঁসির আসামি হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল, আপোষহীন।কোন বাধাই তাকে দমাতে পারেনী।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বিজয়ের লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। তবে তখনো জাতির মনে ছিল না স্বস্তি, বিজয়ের আনন্দ।কারন তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী স্বাধীনতার মহানায়ক।কবে তিনি দেশে ফিরবেন এটা নিয়ে এ ভূখণ্ডের প্রতিটি মানুষ ছিল বিচলিত, আতঙ্কিত। কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিশ্বব্যাপী প্রবল জনমত গড়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশও বিশ্ববাসীর কাছে তার নেতার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি জানালে বিশ্বনেতৃবৃন্দও এ ব্যাপারে সোচ্চার হন।
অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দেয়। ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে স্বদেশে ফিরে আসেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালি। বাঙালি জাতির মহান এক বিজয়ের ফলেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফিরে আসেন। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডন-দিল্লী হয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বিজয়ের মালা পরে। সেদিন বাংলাদেশে ছিল এক উৎসবের আমেজ।
গোটা বাঙালি জাতি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল কখন তাঁদের প্রিয় নেতা, স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন দেশের মাটিতে আসবেন। পুরো দেশের মানুষই যেন জড়ো হয়েছিল তৎকালীন তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায়। বিমানবন্দর থেকে তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত রাস্তায় জনতার ঢল নামে। বন্দীর নাগপাশ ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু বিজয়ের বেশে নামলেন বিমান থেকে। পা রাখলেন লাখো শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। গোটা জাতি সেদিন আনন্দ অশ্রু ঝরিয়ে তেজোদীপ্ত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে তাদের প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানান।বঙ্গবন্ধুও দুহাত প্রসারিত করে বাঙ্গালী জাতিকে পরম মমতায় আপন করে নেন।
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments