আত্রলিতা || সাদিয়া শাহরিণ শিফা || পর্ব : ১৪
উপন্যাস : আত্রলিতা
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ১৪
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ১৪
গত দুদিন যেন নিঃশ্বাস নেবারও সময় পায়নি আহিল। তার বাবার ডাক্তার দেখিয়ে, ডাক্তারের দেয়া একগাদা টেস্ট করিয়ে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখানোর পর ডাক্তারের মুখ সুবিধার ছিল না। ফুসফুসের ৭০ ভাগ অংশে ইনফেকশন ছড়িয়ে গেছে, কিছু অংশ অকেজো হয়ে গেছে। তার ভাষ্যমতে, ইমিডিয়েট অপারেশন করা গেলে এই রোগের সমাধান কিছু একটা করা যেতেও পারে। তবে চান্স ৫০/৫০। একদম সিওরলি বলা যাচ্ছে না যে এই পেসেন্ট রিকভার করবে। আহিলের এই শব্দগুলো শুনে হাত পা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। এত টাকা জোগার করবার সামর্থ্য তার নেই। তাকে দেবার মত কেউ নেই। রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন নিয়ে চেম্বার থেকে বেরোতেই কষ্ট হচ্ছিল তার। ছোটবেলা থেকে একটাই স্বপ্ন দেখেছে সে, বাবা মায়ের জন্য যেন কিছু করতে পারে..আজ সে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করবার আগেই যদি বাবা মায়ের কিছু একটা হয়ে যায়, যদি সে কিছু করার সুযোগটুকু পর্যন্ত না পায় তাহলে জীবনটাই যেন বৃথা! ছোটবেলা থেকে আহিল পড়াশোনায় ভালো তবে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না কখনোই। তবুও এই বাবাই তাকে উৎসাহ দিয়ে গেছে। ভার্সিটি ভর্তির টাকা, ঢাকাতে প্রথম এসে থাকা সবকিছু বাবা কিভাবে ম্যানেজ করেছে আহিল ভাবতেও পারে না! আজ তার পালা, সেই ঋণ শোধ করবার। কিন্তু আজ ভাগ্য তাকে এমন জায়গায় দাড় করিয়েছে যেখানে সে নিরুপায়!
বড় ভাইকে ফোন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সবটা বুঝিয়ে বলেছিল সে। কিন্তু তার ভাইয়ের কথা শুনে মনে হলো সে এসবে ইন্টারেস্টেড না, বললো,” শোন, বাবার বয়স হয়েছে। একদিন না একদিন তো যেতেই হবে সব ছেড়ে। আর অপারেশন করলেও যে সুস্থ হবে এর গ্যারান্টিও তো ডাক্তার দেয়নি। শুধু শুধু এতগুলো টাকা অপারেশনের পেছনে ইনভেস্ট করে কোনো লাভ আছে!”
ফোন রাখার পর চোখের কোণে জল নিয়েই মুচকি হাসলো আহিল। মনে মনে বললো,” উইকেন্ডে বাইরের দেশে ট্যুর দেয়ার পেছনে ইনভেস্ট করতে পারো,, আর আজ বাবার অপারেশনের ইনভেস্টমেন্টে লাভ খুঁজছো!”
আজ বিকেলে বাবা চলে যাবার সময়, সারাদিন, মেসে বসেও বেশ চুপচাপ ছিলেন। বাস স্ট্যান্ডের যাত্রীছাউনিতে শান্তভাবে আহিলের পাশে বসে ছিলেন। কন্ট্রাক্টররা কয়েকবার ডেকে গেল বাস এসেছে বলে। আহিল ব্যাগ তুলে বাবাকে বললো,”চলো বাবা। ঠিকমত ওষুধ খেও বাড়ি গিয়ে। আর পৌঁছেই ফোন দেবে”
হুট করে আহিলের হাত চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। চমকে গেল আহিল। বললো,”কি হয়েছে বাবা?!”
- “আমার খুব বড় অসুখ করেছে না রে?”
- “না বাবা। তোমাকে তো বললাম। এই ওষুধ গুলো খাবে। আর কিছুদিন পর ছোট্ট একটা অপারেশন। আমি তো চেষ্টা করছি! ঠিক সবকিছু ম্যানেজ করে নেব”
- “ তুই এত বড় হয়ে গেলি কবে বাবা? আজ আমাকেও মিথ্যা বলে বুঝ দিচ্ছিস!”
আহিল চোখে পানি নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো অপলক।
বাস ছেড়ে দিবে, এখন ওঠা দরকার। ভদ্রলোক চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,
“আমি যাই রে আহিল বাবা। শোন বাবা, তুই ব্যস্ত হস না। নিজের শরীরের ভাব তো নিজে বুঝি! আমি আর বেশিদিন নাই রে। জানি না তোর সাথে আর দেখা হবে কিনা। একটা কথা বলি বাবা, তোর মনটা খুব নরম। হুট করেই অন্য কারো জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার মতো কোনো সিদ্ধান্ত নিস না। আমি জানি তুই তাও পারিস! নিজের কথাটাও একটু ভাবিস বাবা, নিজের খেয়াল রাখিস।“
কথাগুলো বলতে বলতে বাসে উঠে গেল সফেদ পাঞ্জাবি পরিহিত সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। আহিলের এই মুহূর্তে খুব ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে বাবাকে একটা বার বুকে জড়িয়ে নেয়ার। তা আর হলো না, চোখের পলকে বাস সাঁই সাঁই করে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।
No comments