কেন হুতিদের ওপর হামলা
ইউক্রেন থেকে ঘুরতে ঘুরতে যুদ্ধ এখন ইয়েমেনে। সেখানকার হুতি গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, গত নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্য করে ইরান সমর্থিত হুতিদের হামলার জবাব হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের সূত্রে জানা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মম হামলার প্রতিবাদে লোহিত সাগরে সব ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজ আটকে দিচ্ছে ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী। এতে লোহিত সাগর দিয়ে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য সরবরাহ।
শনিবারও সেখানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। হুতি বিদ্রোহীদের অন্তত ৩০ অবস্থানে যৌথ হামলার একদিন পর একাই হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
হুতি কারা
হুতিদের আবির্ভাব ঘটে ১৯৯০-এর দশকে। এটি একটি সশস্ত্র শিয়া গোষ্ঠী। যে কারণে ইরানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শিয়া দলটিকে ইরানের পুতুল হিসেবে দেখা উচিত নয়। এদের নিজস্ব ভিত্তি রয়েছে। পরে ২০১৪ সালে ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে তারা। তখন থেকে এ গোষ্ঠীর একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। হুতি বিদ্রোহীরা আনসার আল্লাহ নামেও পরিচিত। বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ দেশটির বেশিরভাগ অংশ এবং সৌদি আরবের কাছাকাছি অবস্থিত পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এ গোষ্ঠী।
গোষ্ঠীটির প্রতি ইরানের সমর্থন রয়েছে বলে জানা যায়। হুতিরা সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোটের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে লড়াই চালায়।
সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, তাদের নেতা হুসেইন আল-হুতি শিয়া ইসলামের জাইদি ধারার অনুসরণে ধর্মীয় পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন শুরু করেন। জাইদিরা কয়েক শতাব্দী ধরে ইয়েমেন শাসন করলেও ১৯৬২ সালে গৃহযুদ্ধের পর সুন্নিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এরপর সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ওয়াহাবি মতবাদ মোকাবিলায় আল-হুতি এই আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হলে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। তিনি প্রথমদিকে হুতিদের সমর্থন করতেন। তবে হুতিরা জনপ্রিয় ও শাসকবিরোধী হয়ে উঠতে থাকে। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে সমর্থন দেন সালেহ। এ সুযোগ কাজে লাগান আল-হুতি। জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাদের রাস্তায় নামিয়ে আনেন।
ইয়েমেনি সেনারা ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-হুতিকে হত্যা করলেও আন্দোলনের মৃত্যু হয়নি। হুতিদের সামরিক শাখায় ইয়েমেনি তরুণরা দলে দলে যোগদান করে। তবে এ সময় গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সৌদি আরবের সঙ্গেও হুতিদের যুদ্ধ হয়। জাতিসংঘ জানায়, ইয়েমেন যুদ্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুতর মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
লোহিত সাগর
ইয়েমেন উপকূলের বাব-এল-মান্দেব থেকে মিসরের উত্তরাঞ্চলে সুয়েজ খাল পর্যন্ত বিস্তৃত লোহিত সাগর। বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ সরবরাহ ও ৩০ শতাংশ কনটেইনার এ পথ দিয়ে যায়।
২০২১ সালে ‘এভার গিভেন’ নামে একটি জাহাজ সুয়েজ খালে আটকে পড়লে প্রতিদিন প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য সরবরাহ স্থগিত থাকে। যে কারণে হুতিদের সামরিক শক্তি যা-ই থাকুক, ভৌগোলিক বিচারে তাদের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়, গত ৯ ডিসেম্বর থেকে প্রায় প্রতিদিন লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ টার্গেট করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে হুতিরা। হুতিদের হামলার আশঙ্কায় ইতিমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচটি শিপিং ফার্মের মধ্যে চারটি যথাক্রমে মায়েরস্ক, হাপাগ-লয়েড, সিএমএ সিজিএম গ্রুপ ও এভারগ্রিন লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামও (বিপি) একই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। এতে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ভৌগোলিক হিসাব অনুযায়ী, হুতিদের হামলা এড়াতে চাইলে জাহাজগুলোকে আফ্রিকা হয়ে অধিকতর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। এতে বীমা খরচও বেড়ে যাবে বহুগুণ। পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে গেলে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেবে। এতে করোনা মহামারি-পরবর্তী মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকারকে আরেকটি নতুন ধাক্কা সামলাতে হবে।
হুতিরা বলছে, ইসরায়েল গাজায় খাবার ও ওষুধ প্রবেশ করতে না দেওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না। তাদের প্রত্যাশা, এই প্রতিরোধের ফলে ইসরায়েলের মিত্ররা আর্থিক চাপে পড়বে, এর ফলে গাজায় বোমাবর্ষণ থেকে বিরত হতে পারে ইসরায়েল।
বিবিসি বাংলা জানায়, ইউএস মিলিটারি সেন্ট্রাল কমান্ডের হিসাবে ১৯ নভেম্বর ২০২৩ থেকে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা দক্ষিণ লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মধ্যে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজগুলোতে কমপক্ষে অন্তত ২৬টি হামলা করেছে।
লোহিত সাগরে জাহাজে হুতিদের সাম্প্রতিক হামলায় দেখা গেছে তারা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন (ইউএভি) ও চালকবিহীন জাহাজ (ইউএসভিস) ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া শুরুর দিকে হামলায় দেখা যায়, হুতিরা ছোট ছোট নৌকা বা হেলিকপ্টার নিয়ে বড় জাহাজে উঠে পড়ছে ও সেটা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাইডেন কী চান
দ্য আটলান্টিক বলছে, অন্য দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানরা বলেছেন, বাইডেন সঠিক কাজটিই করেছেন। রিপাবলিকান নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বাইডেন চলমান হুতি হামলার প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করেছিলেন। ইতোমধ্যে সুয়েজ খালে সামুদ্রিক বাণিজ্যের কার্যকলাপ ৯০ শতাংশ কমে গেছে।
যদিও প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাট এবং কঠোর ডান বিচ্ছিন্নতাবাদী রিপাবলিকানদের একটি ছোট দল দাবি করছে, বাইডেনের সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।
জো বাইডেন ক্যাম্প ডেভিডে প্রেসিডেন্টের অবকাশস্থলে যাওয়ার আগে হোয়াইট হাউজে সংবাদদাতাদের বলেন, আমরা ব্যক্তিগতভাবে বার্তা দিয়েছি (ইরানকে) এবং আমরা নিশ্চিত যে আমরা ভালোভাবে প্রস্তুত। তিনি বলেন, ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধে ওয়াশিংটনের কোনো আগ্রহ নেই।
বাইডেন প্রশাসন ২০২১ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে হুতিদের নাম সরিয়ে দিয়েছিল। শুক্রবার সাংবাদিকরা হুতিদের এই হামলাকে সন্ত্রাসবাদ মনে করেন কিনা প্রশ্ন করা হলে বাইডেন বলেন, আমি তাই মনে করি।
বাইডেন আরও বলেন, আমাদের জনগণকে রক্ষা করার জন্য এবং প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অবাধ প্রবাহ রক্ষা করার জন্য আমি আরও ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করব না।
সিএনএনে বিশ্লেষক স্টেফেন কলিনসন লিখেছেন, ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে মার্কিন ও ব্রিটিশ বিমান হামলা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের গতি বৃদ্ধি করবে। আর এসব হামলা এমন সময় ঘটছে, যখন বাইডেন তার নির্বাচন প্রচারণা শুরু করতে যাবেন আর কদিন পর।
ফরেন পলিসির এক কলামে বলা হয়, বাইডেন প্রশাসন চেয়েছিল ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করে স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন। তবে হামাস ইসরায়েলে হামলা চালালে তা নস্যাৎ হয়ে যায়। এরপর থেকে ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পেয়ে ইসরায়েল বেপরোয়া। যার ধারাবাহিকতায় ইয়েমেনেও হামলা করতে হলো বাইডেন প্রশাসনকে।
প্রাথমিক পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর হামলা চালিয়ে বাইডেন তার ভোট নিজের পক্ষে কতটা নিতে পারছেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
আবার আরব ও মার্কিন মুসলিম ভোটারদের মন জয় করতে ইতোমধ্যে বাইডেন সমালোচনা করেছেন ইসরায়েলের। আরব আমেরিকান ইনস্টিটিউট গত মাসে একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, বাইডেনের সমর্থনে ব্যাপক ধস নেমেছে। তাদের মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ চান বাইডেন আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক, যা ২০২০ সালে ছিল ৫৯ শতাংশ।
এর কারণ, গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা চালানোর সময় বাইডেন তাদের আরও ১৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি সহায়তা দিতে কংগ্রেসকে অনুরোধ করেন। যদিও ইসরায়েল আগে থেকেই প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৩৮০ কোটি ডলার সহায়তা পেয়ে আসছে।
তবে বাইডেনকে শুধু মুসলিম ভোটের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। তার দরকার ইহুদি ভোট। পশ্চিমে ইহুদিরা যে দিকে যাবে, জয়ও সেদিকে ঘুরে যায় বলে দেখা গেছে।
চলতি বছরের ৫ নভেম্বর বরাবরের মতোই নির্বাচনের লড়াইয়ে অংশ নিতে যাচ্ছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। তবে এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা, হিসাব-নিকাশ। দুই দল থেকে প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে আছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments