গ্যাস সংকট গড়াতে পারে বিদ্যুতে
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। এতে চুলা জ্বলছে না বাসা-বাড়িতে। গ্যাস সংকটের জাঁতাকলে বন্ধের পথে অনেক শিল্পকারখানার চাকা। শিকে উঠতে পারে উৎপাদনও। আশঙ্কা করা হচ্ছে গ্যাস সংকটের প্রভাব দেখা দিতে পারে বিদ্যুতেও।
যা ব্যবসায়ীদের ওপর নেমে আসতে পারে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে। যদিও গ্যাস সংকটের প্রভাব এখনো পুরোপুরিভাবে দেখা দেয়নি বিদ্যুতে। তবে ইতিমধ্যেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে ব্যবসায়ীদের কপালে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরম পড়ার আগেই গ্যাসের বর্তমান সংকট সমাধান করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে উল্লেখযোগ্য হারে কমতে পারে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে সৃষ্ট বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বাসা-বাড়ির ভোগান্তি ছাড়াও শিল্পকারখানার উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
সরকার বলছে— গ্যাসের এই সংকট সাময়িক। সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া মার্চের মধ্যেই সমস্যা সমাধানের আশাও প্রকাশ করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিতে পারে।
সাধারণ নাগরিকদের মতে, শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। তারপরও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা বলা হচ্ছে। গরমকালে পরস্থিতি কেমন হতে পারে তা ভেবেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে। কাজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে একাধিক ‘বিকল্প উপায় ভাবা হচ্ছে’।
শিল্পকারখানায় সংকট :
শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাসের ব্যবহার হয় পোশাক খাতে। বস্ত্রকলে বাষ্প তৈরিতে গ্যাস ব্যবহার হয় কাঁচামাল হিসেবে। কারখানা মালিকদের মতে দুই বছর ধরেই গ্যাসের সংকট চলছে এই খাতে। তবে নতুন করে গ্যাস সংকট উৎপাদন কাঠামোকে পুরোপুরি এলোমেলো করে দিতে পারে।
সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বলা হচ্ছে গ্যাস সংকটের জাঁতাকলে পড়ে বন্ধ হয়ে আছে অনেক শিল্পকারখানার চাকা। এ কারণে উৎপাদন শিকেয় উঠেছে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহে নেমে এসেছে বিপর্যয়। গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ায় প্রতিদিন কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে বস্ত্র উৎপাদন কমেছে ৬৫ শতাংশ। নিট খাতের উৎপাদন কমেছে ৪০ শতাংশ। ফলে প্রধান পণ্য পোশাক রফতানি কমে গেছে অনেকটাই। দেশে অভ্যন্তরীণ পোশাক বাজারের চাহিদামতো সুতা ও কাপড়ের জোগান কমে গেছে। ফলে এসব পণ্যও আমদানি করতে হতে পারে; যা রিজার্ভে বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।
সরকার বলছে, গ্যাসের এই সংকট সাময়িক। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগির গ্যাস সংকট দূর হবে না। তারা অভিযোগ করেন, দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতেই সরকারের নজর বেশি। ফলে সম্ভাবনা থাকার পরও দীর্ঘদিন গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলা করা হয়েছে।
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।
হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট কেন ?
বাসা-বাড়ি, কলকারখানার পর গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। শনিবার (২০ জানুয়ারি) এক ফেসবুক পোস্টে তারা জানিয়েছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা কমেছে। ‘এই পরিস্থিতিতে দেশের কিছু কিছু এলাকায় খুবই স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতে পারে। সম্মানিত গ্রাহকদের অনাকাঙ্ক্ষিত অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
মূলত দেশে পরিচালিত গ্যাসবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ২০ শতাংশ জ্বালানিই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানি করা এসব এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের পর পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল রাখা হয়েছে, যেগুলো ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ নামেই বেশি পরিচিত। সংস্কারজনিত কারণে জাহাজ দুটির একটি গত নভেম্বর থেকে সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।
এছাড়া কারিগরি ত্রুটির কারণে গত শুক্রবার অন্যটি থেকেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে আকস্মিকভাবেই জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমে যায়। বিশেষ করে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহ প্রায় পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি ওই এলাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে। এই অবস্থায় গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছিল।
তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, শনিবার রাতেই কারিগরি ত্রুটি সমাধান করা হয়েছে। আপাতত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘোষণা দেওয়া হলেও তেমন কিছু আসলে ঘটেনি। তার আগেই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।
যদিও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে।
পেট্রোবাংলাও নিশ্চিত করেছে, ফ্লোটিং স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট থেকে আবার জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) কামরুজ্জামান খান বলেন, পূর্ণ মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ করতে আরও একটু সময় লাগবে।
গরমকাল নিয়ে উদ্বেগ :
শীতকালে সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দৈনিক গড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গরমকালে এই চাহিদা ব্যাপক পরিমাণে বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, গরমকালে সাধারণত ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের চাহিদা দেখা গেলেও এবার সেটি সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের উপরে চলে যেতে পারে। বিপুল পরিমাণ এই বিদ্যুতের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো থেকে। পেট্রোবাংলার হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদাই হবে এবার দেড় হাজার মিলিয়ন ঘটফুটের মতো।
তবে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক চাহিদা হলো ২ হাজার ২৪০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে সাতশ-আটশ এমএমসিএফডি গ্যাস। অর্থাৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে সেটির বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন— কাজেই গ্যাসের বর্তমান সংকট চলমান থাকলে আসছে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
অধ্যাপক ম তামিম তাদেরই একজন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, গরমকালে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যাবে। তখন যদি এই গ্যাসের সমস্যা থাকে, তাহলে গরমকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রকট হবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডেফিনেটলি সেটার একটা নেতিবাচক ইফেক্ট পড়বে।
তবে গ্যাসের এই সংকটের জন্য সরকারের নীতিকেই দায়ী করছেন আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম। তিনি বলেছেন, আমদানি করবো বলে আমরা নিজেদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো অবহেলা করলাম। এখন শীতকালে চাহিদা কম থাকার পরও আমরা গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুল নীতির কারণে একদিকে যেমন গ্যাসের নিজস্ব (দেশের ভেতরে) উৎপাদন কমেছে, তেমনি অন্যদিকে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। এখন ডলার সংকটের কারণে অতিরিক্ত আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আগামীতে জ্বালানি সংকট মোকাবেলা এবং আমদানি করে চাহিদা পূরণ করাই হবে দেশের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এ অবস্থায় সরকারকে আগেভাগেই আসন্ন সংকট মোকাবেলার প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক তামিম বলেন, আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা স্থবিরতা আছে। ফলে এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নেই। এই জ্বালানি সংকট যেটা, সেটা ডলারের সংকট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নেই।
সরকারের পরিকল্পনা কী ?
এরমধ্যে আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাসে বলেছেন, চলতি বছর গরমের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। তাদের এই বক্তব্য সত্যি হলে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা এবারে আরও বাড়বে। যেখানে গরমকালে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া দৈনিক উৎপাদন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গ্যাস সংকটের কারণে এখনই ডজনখানেক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কম হচ্ছে, বেশ কয়েকটি বন্ধও রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে গরমকালে সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে কীভাবে?— বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে এবং আমরা সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও করে রেখেছি।
তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় এবার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতিই সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের বেজলোড কোল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো চলে আসছে। আমরা নিজেরা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, পাশাপাশি ভারত থেকেও বিদ্যুৎ নিচ্ছি। কাজেই সমস্যা হবে না।
দেশে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়, যার একটি বড় অংশই আসে বিদেশ থেকে। ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারায় গত বছর রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধও করে দেওয়া হয়েছিল। তবে চলতি বছর এখনও পর্যন্ত কয়লার সরবরাহ ঠিকই আছে বলে জানিয়েছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ।
কিন্তু ডলার সংকট বা অন্য কোনো কারণে সামনে যদি সরবরাহ ঠিক না থাকে, তখন কী হবে? সেই প্রশ্নে নসরুল হামিদ বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প ভরসা হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। আমাদের নিজস্ব যে গ্যাস আছে, সেখানে হয়তো কিছু রেশনিং করতে হবে।
দেশে ইতিমধ্যেই যেখানে বাসা-বাড়ি ও শিল্প কারখানায় চরম গ্যাস সংকট চলছে, সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত গ্যাসের ব্যবহার কি সংকটকে আরও তীব্রতর করবে না? জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তখন আমাদের অন্য যে সোর্সগুলো আছে, যেমন সিএনজি পাম্প এবং শিল্প কারখানা - সেখানে হয়তো রেশনিং করবো। জোন ভাগ করে সে অনুযায়ী আমরা দেবো, যদি পরিস্থিতি তেমন খারাপ হয়।
তিনি বলেন, জ্বালানি সংকট সমাধানের জন্য সরকার বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহার করছে। এরই অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মতো বিকল্প উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
No comments