বাইশ গজ ছাড়িয়ে বিশাল প্রান্তরে সাকিব
সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়ে হাতের মুদ্রায় বিজয়চিহ্ন দেখিয়ে ক্যামেরাবন্দী হলেন সাকিব আল হাসান। দীর্ঘ শরীর আর চওড়া কাঁধে মুজিব কোটটা দারুণ মানিয়েছে তাঁকে। মিডিয়ার কল্যাণে এই ছবি অনেকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাবে।
ক্রিকেটের ২২ গজে পা থাকতেই রাজনীতির জটিল আর লম্বা ইনিংস খেলতে নেমে পড়লেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়। নতুন এই ইনিংসটা কেমন যাবে তাঁর?
নির্বাচনী প্রচারের সময় ক্যামেরার সামনে, খবরের কাগজের হরফে নিজেই অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, ক্রিকেটের মতো রাজনীতিতেও সেরা অলরাউন্ডার হতে চান। এটা তাঁর আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ নিলে তাঁর চেয়ে আনন্দদায়ী আর কিছু হবে না। যে রাজনীতি জনতার, সেটি লাভবান হবে। যে রাজনীতি মানুষের কল্যাণের, সেটি উপকৃত হবে। কিন্তু ইদানীং যে রাজনীতি ক্ষমতার দম্ভ দেখায়, নিজের কিংবা পরিবারের স্বার্থসিদ্ধির উপায় হয়ে ওঠে, সেই রাজনীতির বৃত্তে ঢুকে পড়লেই মুশকিল। তখন এই তারকা-দ্যুতি গলে গলে পড়বে কাদার মতো। দুই কূল উপচানো মানুষের ভালোবাসার ঢেউ মিলিয়ে যাবে গহিন চড়ায়।
এই উপমহাদেশে ক্রিকেটার থেকে রাজনীতির ময়দানে পা রাখতে আগেও আমরা দেখেছি অনেককে। ইমরান খান, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, কীর্তি আজাদ, চেতন চৌহান, সনাৎ জয়াসুরিয়া, আজহারউদ্দিন, গৌতম গম্ভীর, মনোজ তিওয়ারি, নভজ্যোত সিং সিধু, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মাশরাফি বিন মর্তুজা। গত বছর বাংলাদেশে বিপিএল খেলতে এসে সাকিবের আগে সদ্য উদাহরণটি গড়েছেন ওয়াহাব রিয়াজ। পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকারের ক্রীড়ামন্ত্রী হয়েছেন পাকিস্তানি এই পেসার।
এতগুলো নামের মিছিলে পাকিস্তানের প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার ইমরান খানই শুধু নিজেই নিজের পথ তৈরি করে হেঁটেছেন। নির্বাচনে জিতে পরে হয়েছেন দেশের সরকারপ্রধান। বাকিরা প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রণে মেকশিফট ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার।
তবে সাকিব ইমরান খানের মতো টেস্ট ক্রিকেটে অলরাউন্ড কীর্তি গড়লেও ইমরানের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে পড়বেন না কখনোই। কারণ, রাজনীতির পথটা তিনি নিজে তৈরি করেননি। তিনি হতে পারেন রানাতুঙ্গার মতো, জয়াসুরিয়া-আজাদ-আজহার বা সিধুর মতো। হতে পারেন হাতের কাছের উদাহরণ দুর্জয় বা মাশরাফির মতো। এমনকি গৌতম গম্ভীরের মতো, যিনি ক্রিকেট ছেড়ে এসেও ক্রিকেটের সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন। আইপিএলের দলের মেন্টর ও উপদেষ্টা হচ্ছেন। কারণে-অকারণে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন কোনো ক্রিকেট তারকার সঙ্গে।
সাকিব কি মাশরাফির মতো হবেন? যিনি নিজের নির্বাচনী এলাকার গ্রামীণ জনপদে গিয়ে একটা রবিনহুড ইমেজ দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। গ্রামের সহজ-সরল অভাবী মানুষের সঙ্গে কীভাবে মিশে যাচ্ছেন, তা আমরা দেখছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অজস্র ছবিতে। মাশরাফির মতো হতে পারা সহজ নয়।
তবে আপাত যে পরিস্থিতি তাঁর সামনে, সেটি জটিল। এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের তিন সংস্করণেরই তিনি অধিনায়ক। দেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ বিপিএল দিয়ে তিন মাস পর ক্রিকেটে নেমে পড়বেন কদিন পর। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের একটি দলে দুই মৌসুম খেলতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
আসন্ন মৌসুমটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের জন্য ব্যস্ততম। সংসদ অধিবেশনে যোগ দেবেন, না ২২ গজে থাকবেন, সেটি এক প্রশ্ন বটে। দুই ফ্রন্ট সামলে চলা খুব কঠিন। রাজনীতির মাঠ খণ্ডকালীন তো নয়।
প্রধানমন্ত্রীর শুভদৃষ্টি আছে সাকিবের ওপর। অনেক প্রাপ্তির হাতছানিই হয়তো দেখছেন সামনে। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, তাঁর চোখ ক্রিকেট বোর্ডের বড় চেয়ারটির দিকে। দেশের ক্রিকেট কাঠামোতে একটা ঝাঁকুনি দরকার। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, ক্রিকেট মাঠের অবিচল এই যোদ্ধা, সেই ঝাঁকুনিটা দেওয়ার ক্ষমতা তো রাখেনই। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট এমন কোনো সভাপতি তার মধ্যে দেখতে চাইবে না, যিনি হররোজ ক্রিকেটের সবকিছু নিয়ে কথা বলবেন। যিনি ক্রিকেটের অবকাঠামো ও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত না করে ওপরতলে বসে সবকিছুতে নাক গলাবেন।
ক্রিকেট আর রাজনীতি এক নয়। ক্রিকেটে যেমন বলে, ডিফারেন্ট বল গেম—এ কদিনেই সাকিব সেটি বুঝে ফেলেছেন। ক্রিকেটে কাকভোরে অনুশীলনে গিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ কিংবা আজকাল দিবারাত্রির ক্রিকেটের চাহিদা অনুযায়ী একটি ম্যাচ ডে-তে ১০ ঘণ্টার মধ্যেই হয়তো কাজ শেষ করা সম্ভব। কিন্তু রাজনীতিটা সারাক্ষণ, টোয়েন্টিফোর সেভেন।
নির্বাচনী প্রচারের ফাঁকে সাতসকালের সাকিব আর মাঝরাতে ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখের হাই তোলা সাকিবকে দেখে মনে হয়েছে, রাজনীতির দীর্ঘ, জটিল এবং স্নায়ুক্ষয়ী প্রতীক্ষার প্রান্তর তাঁকে কতটা ক্লান্তি দিতে শুরু করেছে। তবে ভালোবাসার তৃপ্তিও যে পাননি, তা নয়।
অপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যান অব দ্য ম্যাচের মতো প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মাঠে প্রত্যাশিতভাবেই ভূমিধস বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন সাকিব। অনেক ভোটারের সঙ্গেই কথা হয়েছে, যাঁরা ভোট দিয়ে বলেছেন, এমপি সাহেবকে আমরা এ রকম কাছে পাব তো? এই প্রশ্ন, এই সংশয়, এই অনিশ্চয়তা এখন মাগুরা-শ্রীপুরের আকাশে সবচেয়ে ঘনবদ্ধ মেঘের নাম। সাকিব সাধারণ মানুষের কাছে যে দূর আকাশের তারা।
তিনি আজ ঢাকায় তো কাল নিউইয়র্ক। পরশু দুবাই কিংবা লন্ডন। আজ তাঁকে মাগুরার নোমানী ময়দানে ক্ষণিকের জন্য পাওয়া গেলেও কালই তো দেখা যাবে টিভির পর্দায়!
সাকিব অবশ্য কথা দিয়েছেন, তিনি মাগুরাবাসীর পাশে থাকবেন। সু ও দুঃসময়ে। রাজনৈতিক বক্তৃতা রপ্ত করতে পারেননি। ‘জনসমাবেশ’ বলতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছেন। তবে খুব কাছে দাঁড়িয়ে মুখে সংক্রামক হাসি ছড়িয়ে তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘খুব ছেলেবেলায় মাগুরা থেকে দূরে গিয়ে ক্রিকেট খেলেছি। এলাকায় যেহেতু ছিলাম না, আপনাদের উপকার করতে না পারলেও অপকার করিনি। এবার আপনাদের জন্য কিছু করতে চাই। আশা করি সবাইকে পাশে পাব।’ জনতা আপ্লুত। প্রবীণেরা তাঁর মাথায় রাখছেন আশীর্বাদের হাত, অন্যদের করতালিতে মুখর প্রাঙ্গণ। শ্রীপুরে হিন্দুসম্প্রদায়ের এক নামযজ্ঞে গিয়ে তৃপ্তিসহকারে লুচি-লাবড়া খেয়ে বলেছেন, ‘এটা আমার ফেবারিট।’ মাঠের পাশে কৃষকদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছেন তাঁদের খাবার।
রাজনীতিতে এটা কেউ করেন মানুষকে দেখাতে, কেউ করেন অন্তর থেকে। একজন আরেকজনের অন্তরটা পড়তে অক্ষম। তবে তারকা সাকিব দ্বিতীয় দলে পড়লেই ভালো।
বন্ধু রাজীব গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে অমিতাভ বচ্চন রাজনীতিতে নেমেছিলেন। হেমমতি নন্দন বহুগুনার মতো রাজনীতির এক মহিরুহকে পরাজিত করে কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভার সদস্যও হয়েছিলেন। কিন্তু দুই বছরের মাথায় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে ফিরে এসেছিলেন রুপালি পর্দায়, যেটা তাঁর আসল জায়গা। পদত্যাগ করে বলেছিলেন, রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন নেহাতই আবেগের বশে, ওটা তাঁর জায়গা নয়। অভিনয় আর ক্রিকেটটা পৃথক আসলে বয়সের সীমারেখায়। চাহিদা থাকলে অভিনয় আমরণ চালিয়ে যাওয়া যায়, পেশাদার ক্রিকেট নয়। তাই ধরেই নেওয়া যায়, বিগ-বির মতো কাজ সাকিব করবেন না। তবে মানুষের আশা, সাকিব রাজনীতির মাঠে লম্বা ইনিংস খেলতেই এসেছেন। তিনি নিজেও বুঝে গেছেন, চাহিদা এখানে দিগন্তবিস্তৃত নয়। বেশি কিছু চায় না জনতা। একটু আশা, একটু ভরসা, আর আবেগের সঙ্গে বিবেকের সামান্য ভারসাম্য রক্ষা। এর আগে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সঙ্গে বোঝাপড়া। যা বস্তুত এ দেশের ক্রিকেটেরও একান্ত কামনা।
এত দিন মানুষের মন জিততে সাকিবের সামনে ছিল ২২ গজের বৃত্তাকার ভূমি। সেটি এখন বিশাল, বিস্তৃত এক প্রান্তর।
No comments