‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার ‘রইছ’ এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমায় রইছ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন অভিনয়শিল্পী বিজয় চৌধুরী। সিনেমাটিকে সেরা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রইছের বাসা কোনটা? দক্ষিণ বাড্ডার আলাতুন্নেছা স্কুল রোডের গলিতে এক চা-দোকানিকে জিজ্ঞাসা করতেই বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন। গলির মোড়ের চৌধুরীবাড়ির দোতলায় থাকেন বিজয় চৌধুরী। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমা মুক্তির পর থেকে এলাকার মানুষ তাঁকে ‘রইছ’ নামেই চেনেন।
কোনো চরিত্র কতটা শক্তিশালী হলে আসল নাম ছাপিয়ে চরিত্রের নামে পরিচিতি মেলে? টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—নব্বইয়ের থেকে শূন্য দশকের দর্শকমাত্রই রইছকে চেনেন। সিনেমার শেষভাগে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে রইছের মৃত্যুর দৃশ্যে চোখের জল আগলে রাখতে পারেননি অনেকে।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ মুক্তির ২৬ বছর পর আজও চরিত্রটি অমলিন। স্বাধীনতা দিবসে, বিজয়ের মাসে টিভির পর্দায় ফিরে ফিরে আসে ছবিটি; রইছের সেই ‘আইকনিক’ দৃশ্য নিয়েও আলোচনার শেষ নেই। আড়াই দশক পরও পর্দার ‘রইছ’ ২২ বছরে আটকে আছেন। রইছের বয়স না বাড়লেও বিজয় চৌধুরী ৫০ বছর পেরিয়ে ৫১–তে পা দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর (১৯৭৩) জন্ম হয়েছিল বলে ‘বিজয়’ নাম পেয়েছেন তিনি।
দক্ষিণ বাড্ডার এই বাসায় বিজয়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা; পরিবার নিয়ে এই বাসায় থাকেন। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় আসতেই কুশল বিনিময়ের পর ড্রয়িংরুমে বসালেন বিজয় চৌধুরী। আলাপ শুরুর আগে সেই দৃশ্য আবার দেখে নেওয়া যাক। টিভিতে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার সেই দৃশ্য ছাড়া হলো।
দৃশ্যটা চিরচেনা—বুড়ির (সুচরিতা) ঘরে আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে এসেছে পাকিস্তানি হানাদাররা। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী পুত্রসন্তান রইছকে উৎসর্গ করেন মা। রইছের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে পাঠান; বাড়ির আঙিনায় রইছের বুক ঝাঁজরা করে চলে যায় হানাদাররা। আমগাছের তলায় রইছের নিথর দেহ পড়ে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে পাঠিয়ে নিথর সন্তানকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বুড়ি।
১৯৯৪ সালে মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রামে এ দৃশ্য ধারণ করা হয়। টানা ১৮ দিন একটি বাড়িতে সিনেমার বেশির ভাগ অংশের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল। স্মৃতি হাতড়ে ২৮ বছর আগে সেই দৃশ্যে ফিরলেন বিজয় চৌধুরী, তখন তিনি ২২ বছরের টগবগে তরুণ।
এর আগে দু–একটি সিনেমা করলেও গুলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না বিজয়ের। গুলির দৃশ্যের কথা শুনে ভয়েই দুপুরে ভাত খেতে পারেননি তিনি। নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের অভয়ে ভয় ভেঙেছিল তাঁর। তাঁর ভাষ্যে, ‘সেই সময়ে গুলির দৃশ্যে বুকে পটকা বোমা বাঁধা হতো। আমার বুকেও ট্রাকের টিউব পেঁচিয়ে ছয়টা পটকা বোমা বাঁধা হয়, এর সঙ্গে বিদ্যুতের সংযোগ ছিল। পটকা বোমার সঙ্গে বেলুনভর্তি রক্তও ছিল। হানাদারদের গুলির দৃশ্যে সুইচ চাপলেই বোমা ফাটে, রক্তে বুক ভিজে যায়। দৃশ্যটি জীবন্ত ছিল, এক টেকেই দৃশ্যটি নেওয়া হয়েছিল।’
সেই সময়ে গুলির দৃশ্যে বুকে পটকা বোমা বাঁধা হতো। আমার বুকেও ট্রাকের টিউব পেঁচিয়ে ছয়টা পটকা বোমা বাঁধা হয়, এর সঙ্গে বিদ্যুতের সংযোগ ছিল। পটকা বোমার সঙ্গে বেলুনভর্তি রক্তও ছিল।
১৯৯৪ সালেই এই সিনেমায় কাজের সুযোগ পান বিজয় চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের এক সহকারী যোগাযোগ করেন। পরে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন বিজয়। তাঁকে দেখেই রইছ চরিত্রে চূড়ান্ত করেন চাষী নজরুল ইসলাম। চূড়ান্ত করার ২৫ দিন পরই মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রামে সিনেমাটির শুটিং শুরু হয়।
কনকনে শীতের মধ্যে ঝিটকায় টানা ১৮ দিনে দৃশ্য ধারণ করা হয়। ঝিটকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় দৃশ্য ধারণ করা হয়। সিনেমার পোস্টপ্রোডাকশনের কাজ শেষ হওয়ার পরও রাজনৈতিক কারণে মুক্তি পেছায়। প্রায় তিন বছর পর ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এর আগে এফডিসিতে প্রিমিয়ার শো হয়েছিল। সিনেমায় বিজয়ের অভিনয় দেখে প্রশংসা করেছিলেন খল অভিনেতা রাজীব, বুকে জড়িয়ে ধরে বিজয়ের পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
চরিত্রটি বিজয়ের বাবা মোহাম্মদ মনির চৌধুরীকেও ছুঁয়ে গেছে। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছেলের সিনেমা দেখেছিলেন তিনি। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে মনির চৌধুরী জানালেন, এলাকার বন্ধুরা এখনো তাঁকে ‘রইছের বাবা’ বলে ডাকেন। অবসরপ্রাপ্ত এই চাকরিজীবী বলেন, ‘আমি গুলশান পার্কে রোজ সকালে হাঁটি, আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলেই আমাকে “রইছের বাবা” বলে ডাকে। ছেলের জন্য আমি গর্ব বোধ করি।’
রইছের মৃত্যুর দৃশ্যটি আবেগতাড়িত করে মনির চৌধুরীকে। শিল্পী, নির্মাতাদের অনেকে ভেবেছিলেন, রইছ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাবেন বিজয় চৌধুরী। তবে পুরস্কার না পেলেও তা নিয়ে আক্ষেপ নেই বিজয়ের। সে বছর সিনেমার পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম, অভিনেত্রী সুচরিতা ও কাহিনিকার সেলিনা হোসেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
এর আগে ১৯৯৩ সালে পরিচালক রায়হান মুজিবের ‘প্রেমপ্রীতি’ সিনেমা দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক ঘটে বিজয়ের। মাঝে আরও দু-তিনটি সিনেমা করলেও রইছকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ১৯৯৭ সালে ‘লাট ভাই’-এর পর আর কোনো সিনেমায় পাওয়া যায়নি তাঁকে।
আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে সিনেমার বাইরে রয়েছেন তিনি। কারণ কী? বিজয় বলছেন, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ মুক্তির পর অনেক সিনেমার প্রস্তাব পেলেও কোনো চরিত্রই পছন্দ হয়নি তাঁর। ভালো চরিত্র না পাওয়ায় সিনেমা থেকে দূরে চলে গেছেন তিনি। সিনেমা না করলেও মাঝেমধ্যে টুকটাক টিভি নাটকে দেখা গেছে তাঁকে। ভালো চরিত্র পেলে আবারও সিনেমা ও নাটকে নিয়মিত কাজ করতে চান তিনি।
১৯৯৩ সালে পরিচালক রায়হান মুজিবের ‘প্রেমপ্রীতি’ সিনেমা দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক ঘটে বিজয়ের। মাঝে আরও দু-তিনটি সিনেমা করলেও রইছকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ১৯৯৭ সালে ‘লাট ভাই’-এর পর আর কোনো সিনেমায় পাওয়া যায়নি তাঁকে।
এখন কী করছেন
মাঝে আড়াই দশকে আর কোনো সিনেমা করেননি। টুকটাক নাটক করলেও নিয়মিত নন। অভিনয়ের বাইরে মূলত ব্যবসায়ী হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিজয় চৌধুরী। দু-তিন বছর ধরে তৈরি পোশাক রপ্তানি করছেন তিনি। চার বন্ধুর সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে ঢাকার বারিধারা ডিওএইচএসে অফিস নিয়েছেন। বিভিন্ন কারখানা থেকে সোয়েটার নিয়ে কলকাতায় রপ্তানি করছেন তাঁরা।
এর আগে মতিঝিলে ‘উনুন’ নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল বিজয়ের। প্রায় এক যুগ ধরে রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেছেন তিনি। করোনাভাইরাসের মধ্যে সেটি বন্ধ করে পোশাক রপ্তানি ব্যবসায় হাত দেন।
আমি বাড়িতে ঢুকতেই এক বয়স্ক নারী বলছিলেন, দেখ, রইছ এসেছে। শুনে আমার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। ২৮ বছর পর আমাকে চিনতে পেরেছেন, এটা ভেবেই আবেগতাড়িত হয়েছিলাম।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার দৃশ্যধারণ যে গ্রামে হয়েছে, সেই গ্রামটি বিজয়ের মেয়ে ফিওনার ভীষণ প্রিয়। শৈশব থেকেই সিনেমাটি বহুবার দেখেছে ফিওনা। সিনেমার গ্রামে যাওয়ার আবদার করত সে। মেয়ের আবদার পূরণে গত বছর বিজয় দিবসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেই বাড়িতে গিয়েছিলেন বিজয় চৌধুরী।
২৮ বছর পর মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রামের সেই বাড়িতে গিয়ে আপ্লুত হয়েছেন বিজয়। তিনি বলেন, ‘আমি বাড়িতে ঢুকতেই এক বয়স্ক নারী বলছিলেন, দেখ, রইছ এসেছে। শুনে আমার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। ২৮ বছর পর আমাকে চিনতে পেরেছেন, এটা ভেবেই আবেগতাড়িত হয়েছিলাম।’
সিনেমায় দেখানো রইছদের ঘরটা এখনো আগের মতোই আছে। বাড়ির পেছনে পুকুরটাও আছে। সেই বাড়ির সঙ্গে বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে বিজয়ের।
সেদিন পর্দার রইছকে পেয়ে রীতিমতো উৎসব নেমেছিল ঝিটকা গ্রামে। আশপাশের দশ গ্রাম থেকে শত শত মানুষ তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ মুক্তির পর বাড়িটি শুটিং বাড়ি হিসেবেই পরিচিতি পায়, এরপর এখানে বহু বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে।
বিজয়-বৃত্তান্ত
বিজয় চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ বাড্ডায়। ১৯৯১ সালে সাভার অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৯৩ সালে ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। একই কলেজ থেকে বিকম সম্পন্ন করেছেন।
১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন বিজয় চৌধুরী। তিনি ও তাঁর স্ত্রী সালমা চৌধুরীর সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে সাবিত চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, গত বছর বিয়ে করেছেন সাবিত। মেয়ে ফিওনা আজাদ উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে।
বিজয়ের বাবা মোহাম্মদ মনির চৌধুরী একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, মা মিনা চৌধুরী গৃহিণী। বিজয়রা তিন ভাই ও এক বোন। দুই ভাই আয়ারল্যান্ডে থিতু হয়েছেন।
No comments