শরীফার গল্প পর্যালোচনায় ৫ সদস্যের কমিটি
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অধ্যায়ের ‘শরীফার গল্প’ নামের গল্পটি পর্যালোচনা করার জন্য উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাঁচ সদস্যে এই কমিটিতে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুর রশীদকে আহ্বায়ক করা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা আলীয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক একটি পাঠ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে। আসলে কী আছে পাঠ্যবইয়ে। জানা গেছে, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ বিষয়ক অধ্যায়ের একটি অংশে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়েছে। সেই অংশে আছে, খুশি আপা (শিক্ষক) ক্লাসে একজন অতিথিকে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন নিজের স্কুলটা দেখতে। সুমন (শিক্ষার্থী) জানতে চাইল, আপনার নাম কী? তিনি বললেন, আমার নাম শরীফা আকতার। এরপর শরীফা তার জীবনকাহিনি বলতে শুরু করেন। শরীফা বললেন, যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম, তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং (শিক্ষার্থী) অবাক হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে? শরীফা বললেন, আমি তখনও যা ছিলাম, এখনও তা-ই আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ওরা শরীফার কথা যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারল না।
আনাই (শিক্ষার্থী) তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়? শরীফা বললেন, আমার বাড়ি বেশ কাছে। কিন্তু আমি এখন দূরে থাকি। আনাই মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, আমার পরিবার যেমন অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছে, আপনার পরিবারও তেমনি এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। শরীফা বললেন, তা নয়। আমার পরিবার এখানেই আছে। আমি তাদের ছেড়ে দূরে গিয়ে অচেনা মানুষদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। এখন সেটাই আমার পরিবার। তাদের অবাক হতে দেখে শরীফা এবার নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলেন।
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।
ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময় বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতাম। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না। বোনদের সাজার জিনিস দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজতাম। ধরা পড়লে বকাঝকা, এমনকি মারও জুটত কপালে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়াপড়শি-এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম, এ কথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।
একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)। সেই মানুষটা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে নারী-পুরুষের বাইরে আরও নানা রকমের মানুষ আছেন। তাদের বলা হয় ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী। তাদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো না যে আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়মকানুন, ভাষা, রীতিনীতি আমাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা। আমরা সবার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের মতোই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয়। তাই মাঝেমধ্যে বাড়িতেও যাই।
আজ থেকে ২০ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছি। সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। আমাদেরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। এখনও বেশিরভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না। তবে আজকাল অনেক মানুষ আমাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ইদানীং আমাদের মতো অনেক মানুষ নিজ বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে। আমাদের মতো মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। অনেক দেশেই তারা সমাজের বাকি মানুষের মতোই জীবন কাটায়। তবে আমাদের দেশের অবস্থারও বদল হচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে। শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রচেষ্টা নিচ্ছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী রানী চৌধুরী, বিপুল বর্মণের মতো বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ সমাজ ও পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। এরপর কর্মক্ষেত্রে সফল কয়েকজন হিজড়ার ছবি দেওয়া হয়েছে।
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।
তারপর বলা হয়েছে, ওরা (শিক্ষার্থী) এত দিন জানত, মানুষ ছেলে হয় অথবা মেয়ে হয়। এখানেও যে বৈচিত্র্য থাকতে পারে, সে কথা ওরা কখনো শোনেনি, ভাবেওনি। কিন্তু শরীফা আলাদা রকম বলে সবাই তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এমনকি তার পরিবারের লোকেরাও! শরীফার জীবনকাহিনি শুনে সবার মন এমন বিষাদে ভরে গেল যে তাকে আর বেশি প্রশ্ন করতেও ইচ্ছে করল না। এরপর শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা ও নানা প্রশ্নের মাধ্যমে শেখার অংশ রয়েছে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সাংবাদিকদের বলেছেন, পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক পাঠ অংশের উপস্থাপনায় কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকলে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করলে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে। বইয়ে শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার নয়, থার্ড জেন্ডার আছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সেটি আইনত স্বীকৃত, যারা জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) কারণে তৃতীয় লিঙ্গ বা সামগ্রিকভাবে সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত। তারা এ দেশের নাগরিক। অবশ্যই তাদের নাগরিক সুবিধা আছে।
No comments