আত্রলিতা || সাদিয়া শাহরিণ শিফা || পর্ব : ০৯
উপন্যাস : আত্রলিতা
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ০৯
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ০৯
ঘড়ির কাঁটায় দুপুর পৌনে একটা। আব্দুর রহমান সাহেব নিজের ডেস্কের চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছেন। একটু পরেই অফিসের লাঞ্চ আওয়ার শুরু হয়ে যাবে। অথচ সকালের কাজগুলোই সব পড়ে আছে এখনও। বিকেল থেকে আবার এমডির সাথে মিটিং, এই নতুন এমডি আসার পর আজকাল খুব কড়া হয়ে গেছে অফিসের নিয়ম। হুটহাট লোক ছাঁটাই করে দিচ্ছেন তিনি। তাই কাজগুলো বিকেলের মধ্যে শেষ করে রাখাই ভালো। কিন্তু রহমান সাহেব কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছেন না। কাল রাতে আত্রলিতাকে তিনি কোনোমতে সামাল দিয়ে এসেছেন। সকালে আসবার সময়ও দেখে এসেছেন মেয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙলে আবার কি অবস্থা হয় কে জানে? ‘তাহলে কি ওর অসুখটা আরো বেড়ে গেল!’ মনে মনে কথাটা ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। অহম বাসায় ওর কাছে একা আছে এই দুশ্চিন্তাও তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ফুলবুয়াকে যদিও বলা আছে বেশি পাগলামি করলে ঘরে তালা দিতে..
‘পাগলামি.. কেন আমার মেয়েটা এমন হয়ে গেল? হাসিখুশি থাকতো সবসময়, সবাইকে সামলে রাখতো। ওর মায়ের যখন অসুখ করলো তখনও দিব্যি সুস্থ মেয়েটা.. তাহলে কি ওর মা চলে যাবার পর আমিই ঠিকমত দেখে রাখতে পারিনি ওকে!’
চোখের কোণে জল ভরে আসতে চাইলো। রহমান সাহেব সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলেন। বৃদ্ধ হলে মানুষের আবেগের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও কমে যায় বোধহয়!
মিনিট পনেরো কি বিশ বাদে পাশের ডেস্কের জলিল সাহেব উঠে এলেন। সামনের চেয়ারে বসে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে অদ্ভুত ভঙিতে হাসি দিলেন তিনি। রহমান সাহেব খুব ভালো করে জানেন এখানে তার এখন কোনো কাজ নেই। তবে এই লোকটার কাজই হচ্ছে অফিসে কারণে অকারণে সবার পেছনে লাগা আর এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে লাগানো।
দুই তিন মিনিট মনোযোগ দিয়ে নিজের দাঁত খোচানোর পর জলিল সাহেব সোজা রহমান সাহেবের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি ভীষণ ব্যঙ্গাত্মক।
-“কি ব্যাপার রহমান সাহেব? কাজ কতদূর..”
রহমান সাহেবের প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো, কোনোমতে মুখে হাসি টেনে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,” এইতো চলছে..”
পুরো কথা শেষ করার সময় না দিয়ে জলিল সাহেব বলে উঠলেন,”দেখবেন, রিটায়ারমেন্টের আগে চাকরিটা খেয়ে বসবেন না যেন। ঠিকমত কাজ করুন।“
এবার রহমান সাহেব কড়া গলায় উত্তর না দিয়ে পারলেন না, “আমি যতদূর জানি জলিল সাহেব, আপনি আমার জুনিয়র। আপনি আমাকে কাজ শেখাবেন? চাকরি ধরে রাখা না রাখার বিষয়ে জ্ঞান দিবেন? আমি তো তাও এই কত বছর ধরে কাজ করছি, আপনি বরং নিজের কাজটা ঠিকমত করুন নাহলে আপনাকেই পরে চাকরি ধরে রাখবার জন্য এত স্বল্প চাকরির বয়সেই না দৌড়াতে হয়”
-“এই দেখুন রহমান সাহেব! এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আপনি বাপু বড় রাশভারী মানুষ। কোনো কথা ছোঁয়ানো যায় না। তা আপনার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে?” চোখে কুটিলতা এনে প্রশ্ন করলেন জলিল সাহেব।
রহমান সাহেব বুঝতে পারলেন ওই লোক এবার ব্যক্তিগত জায়গায় আঘাত করে আক্রোশ মেটাবে, এজন্য সন্তান প্রসঙ্গে গিয়েছেন, বহুত খারাপ লোক।
-“ভালো” কড়া গলায় জবাব দিলেন রহমান সাহেব।
-“তা মেয়ের বয়স তো কম হয়নি, বিয়ের কথা ভাবছেন না?”
ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশ্রী ভাবে হাসলো লোকটা। পরক্ষণেই জিহ্বা কামড়ে মেকি অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন,”ধুর আমিও বা কি বলছি! আপনার মেয়ে তো মানসিক ভারসাম্যহীন, পাগল আরকি। তাইনা! যাকগে যাক, উঠি আমি, যাই। লাঞ্চ আওয়ার হয়ে গেল..”
জলিল সাহেব চলে যাবার কিছুক্ষণ পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন রহমান সাহেব। মনকে সান্তনা দিলেন,”এ আর নতুন কি!”
আত্রলিতার শরীর খারাপের পর থেকেই পাড়া প্রতিবেশী, অফিস কলিগরা সুযোগ পেলেই এটা নিয়ে কথা শোনায়। আত্মীয় স্বজনরা তো খোঁজ ও রাখে না, এক প্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করেছে, উপর থেকে যেচে যোগাযোগ করতে গেলে খোঁটা দেয়। পাগল মেয়ের বাবা হওয়া, অসুস্থ সন্তানের বাবা হওয়া বোধহয় পাপ।
. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।
মাঝেমাঝে আব্দুর রহমান সাহেব আর পারেন না এতকিছু সহ্য করতে, প্রচন্ড যখন হাঁপিয়ে ওঠেন, তখন তিনি তার স্ত্রীর কথা ভাবেন। সে থাকলে হয়তো এই কষ্টের বোঝা তাকে একা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হতো না। আর এই কষ্টের শেষ কোথায় তাও তিনি জানেন না। হয়তো মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে মানুষের কথার ভার।
বিকেলের মিটিংয়ে নতুন এমডি দুজনকে ছাঁটাই করলেন এবং ছয়জনকে ওয়ার্নিং নোটিশ দিলেন। সৌভাগ্যবশত আব্দুর রহমান সাহেবের নামটা ওয়ার্নিং নোটিশে ছিল।
No comments