মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জয়লাভ করা বিরল ঘটনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা- সর্বোপরি তাঁর ব্যক্তিত্ব এই সামরিক নেতৃত্বকে যুদ্ধ জয়ে উজ্জীবিত করেছে। এই যুদ্ধের সার্বিক সাফল্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ জনগণের। কারণ যুদ্ধ পরিচালনায় সাধারণ মানুষের সার্বিক সহযোগিতা অন্যতম অনুঘটক। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবদানকে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা খুবই দুরূহ। প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তা সামরিক যুদ্ধ কৌশলের মাপকাঠিতে অনন্য। আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার অন্যতম সমর কৌশল এই গেরিলা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মার্চে টালমাটাল রাজনৈতিক অস্থিরতার চূড়ান্ত রূপ পায় ২৫ মার্চ রাতে 'অপারেশন সার্চলাইট' বাস্তবায়ন এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের সশস্ত্র লড়াই শুরু করার নির্দেশ আসে ২৫ মার্চ রাত দেড়টায় (২৬ মার্চ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দি হওয়ার প্রাক্কালে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বিভিন্ন বাঙালি ইউনিট, ইউনিটে অবস্থানরত ও ছুটিতে অবস্থানকালীন সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাসদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধে অবতীর্ণ হয়। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকটি ইউনিট এবং ইপিআর সদস্যরা সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রাথমিক প্রতিরোধকে একটি সশস্ত্র সাংগঠনিক কাঠামোতে রূপ দেওয়ার প্রথম দৃশ্যমান সামরিক পদক্ষেপ '১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিলের তেলিয়াপাড়া সম্মেলন'। তৎকালীন সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোয় অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং মুক্তিযুদ্ধকে একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় আনতে বাঙালি অফিসারদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় তেলিয়াপাড়া (৪ ও ১০ এপ্রিল ১৯৭১) সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পুরো বাংলাদেশে প্রাথমিক প্রতিরোধ চলতে থাকে। বাংলাদেশকে চারটি (পরবর্তীকালে ৬টি) সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সামরিক অফিসারদের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলতে থাকে। অসামরিক যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, যুদ্ধের কৌশল, মৌলিক যুদ্ধ প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়ে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সংগঠনের মাধ্যমে 'যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী'র একটি প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করা হয়।
শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আগরতলায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর ১২ এপ্রিল কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং কলকাতায় বাংলাদেশ ফোর্সেসের সদরদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং কর্নেল ওসমানী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এই অস্থায়ী সরকারের অধীনে কর্নেল ওসমানী ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের অস্থায়ী সদরদপ্তর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন।
১৯৭১ সালের ১২ জুলাই থেকে পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করার আগ পর্যন্ত অঞ্চলভিত্তিক সামরিক নেতৃত্বের মাধ্যমে যুদ্ধ চলতে থাকে। ১১টি সেক্টরের সামরিক কমান্ডারদের আওতায় অন্যান্য গেরিলা বাহিনী ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে আরও তীব্র বেগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া গাইডলাইন মেনে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত সব আদেশ-নির্দেশনা কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ফোর্সেসের মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিশ্বদরবারে প্রশংসিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা, দৃঢ় মনোবল ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সারাবিশ্বে অনন্য উদাহরণ।
মেজর মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন ভূঁঞা, এইসি: সেনা কর্মকর্তা
No comments