Adsterra

১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি

ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Today Trending News, Today Viral News, Top News, Hot News, ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি, আইয়ুব খানের সামরিক


নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি দিনটি ছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী মিছিল-আন্দোলনে মুখরিত একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান দিবস। ওই দিন সামরিক সরকার ঘোষিত সব বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা একযোগে শামিল হয়েছিল বিক্ষোভ মিছিলে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রেরণা। 


স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে বলবৎ করা হয়েছিল সামরিক শাসন। আর সেই সামরিক শাসন জারি করার পরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনজীবনে যে নৈতিকতার অবক্ষয় এবং সামাজিক জীবনে ভাঙনের সূত্রপাত হয়েছিল তারই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষই ফুঁসে উঠেছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, যার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের জীবনে। 


প্রকৃতপক্ষে আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দিনে দিনে যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য গড়ে উঠেছিল পরবর্তীকালে বলা যায়, তা-ই, ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। 


দেখা গেছে, আইয়ুবী সামরিক শাসনামলে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতো তা এই অঞ্চলে নয় বরং, পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি ধনী পরিবারের আয়-উপার্জন এবং সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করত। 

এ ছাড়াও ছিল বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পাশাপাশি সামরিক আমলাতন্ত্রের অস্বাভাবিক ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের গণস্বার্থবিরোধী তৎপরতা যা সেই সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছিল। 


এভাবে ওই সময়ে জনজীবনে চলমান অর্থনৈতিকসহ নানা বৈষম্য, অসংগতি এবং সামাজিক নিষ্পেষণের প্রেক্ষাপটেই ধীরে ধীরে রচিত হয়েছিল গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি। এই সঙ্গে ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারতযুদ্ধের প্রতিক্রিয়াও পরবর্তীকালে আরও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল। 

ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই  "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।

ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই  "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।

তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের চাকরি-বাকরি, জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নানা রকম বঞ্চনা ও বৈষম্য সৃষ্টি করা শুরু কওে, যার ফলে পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণ এবং শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমশ দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যে দূরত্ব পরবর্তীকালে আর কমানো সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি ‘৬৫’ সালের যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরাপত্তা সম্পর্কেও শাসকগোষ্ঠী ছিল রীতিমতো উদাসীন। তাদের এই অমানবিক আচরণ এ দেশের বাঙালিদের মধ্যে রীতিমতো ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। 


এদিকে ১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির ত্রাতা শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে যে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন তার প্রভাবও বিপুলভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল এর সঙ্গে ও আঁধারে আলোক শিখার মতো সেই ছয় দফা দাবিকে বাঙালিরা নিজেদের ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে ধরে নিয়ে পরবর্তীকালে ঊনসত্তর সালে গণজোয়ারে পরিণত করেছিল।


এরপরে আসে ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সেই মামলাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর অনুসারী আরও ৩৫ জনকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। অভিযোগে বলা হয়, বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর অনুসারীরা ভারতের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে সমগ্র পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করার অজুহাতে আটক করে রাখা হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে।


একসময় ঢাকায় এই প্রহসনের মামলার বিচার শুরু হয় বিচারপতি এস এ রহমানের নেতৃত্বে। গ্রেফতার করা হয় প্রধান অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানকেও। শেখ মুজিবের গ্রেফতার পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়। পরবর্তীকালে তা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নির্যাতন ও সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে চরম বহিঃপ্রকাশ ছিল গড়ে ওঠা এই গণ-আন্দোলন। 


বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে বাংলার আত্মসচেতন সংগ্রামী বাঙালি জাতি এবারেও অসীম সাহসের সঙ্গে পুনরায় নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে নির্ভয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সামরিক সরকারবিরোধী শোষিত-বঞ্চিত বাঙালিদের আন্দোলন ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে বছরের শুরুতেই ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিশাল মিছিল বের হয়। সেই মিছিল প্রতিরোধে এগিয়ে আসা পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। 


তারপরে ২৪ জানুয়ারি চলমান আন্দোলন দমনে নিয়োজিত পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে নব কুমার ইনস্টিটিউশনের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক, মকবুল, রিকশাচালক রুস্তম আলী এবং আলমগীর-এই চারজন নিহত হন। 


সেই সময়ের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সম্পর্কে সংগ্রামী ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘আসাদের গায়ের জামা দিয়ে পতাকা তৈরি করলাম ও তার লাশ শহিদ মিনারে রেখে শপথ নিলাম, আসাদ, তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেব না


২৪ জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়। পল্টনে লাখ লাখ লোক জমায়েত হয়। ঢাকা শহরের সব মানুষ রাজপথে নেমে আসে। আগুন জ্বলছে। মানুষের স্রোত পল্টনের দিকে। এই যে মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর-এই চারজনকে গুলি করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগরতলা মামলার সাক্ষী, তৎকালীন মন্ত্রী, এমনকি বিচারপতির বাড়িতেও মানুষ আগুন লাগিয়ে দিল।’


ছাত্রনেতা আসাদ, মতিউর ও অন্যদের মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা একযোগে সব বাধা উপেক্ষা করে বিশাল মিছিলসহকারে রাস্তায় নেমে আসে এবং স্বৈরাচারী সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবির মূল ভিত্তি ছিল ৬ দফা, পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। 


চলমান তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে একসময় পিছু হটতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার। মিছিলে সেøাগান ওঠে, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনব।’শেখ মুজিব তখন সমগ্র বাঙালি জাতির মুক্তির দূত হয়ে উঠেছেন এদেশের কোটি কোটি আন্দোলনরত সংগ্রামী জনতার কাছে।


১৫ ফেব্রুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয় আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে। তারপর ১৭ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা নিহত হন পুলিশের গুলিতে। এই দুটি ঘটনা আন্দোলনরত ছাত্র- জনতাকে আরও কঠোর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি চলে যেতে থাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।


জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরাতে এবং তার শাসনামলকে সবার কাছে স্মরণীয় করে রাখতে প্রচুর অর্থের অপচয় করে একসময় বেশ বড়সড়ো আয়োজনে উদযাপন করেছিলেন ‘উন্নয়নের দশক ’। কিন্তু তাতেও তেমন কোনো কাজ হয়নি।


প্রবল আন্দোলনের মুখে অবশেষে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ২২ ফেব্রুয়ারি মামলার প্রধান অভিযুক্ত শেখ মুজিব এবং অন্য অভিযুক্তদেরসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। 


পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে ভূষিত করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। 

এর পরবর্তী ঘটনাগুলো দ্রুতই ঘটতে থাকে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উদ্ভূত অচল অবস্থা দূর করার লক্ষ্যে এক জরুরি গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে সব রাজনৈতিক দলের নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।


কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অবস্থা সামাল দিতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে সরিয়ে ড. এস এন হুদাকে গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। 

কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন তথাকথিত লৌহমানব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান।

No comments

Powered by Blogger.