আত্রলিতা || সাদিয়া শাহরিণ শিফা || পর্ব : ০৪
উপন্যাস : আত্রলিতা
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ০১
খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছেন আব্দুর রহমান সাহেব। সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টিতে গা হাত পা প্রচন্ড ব্যথা করছে বলে অফিস কামাই দিয়েছেন। বলে কয়ে নেয়া ছুটি নয়, অঘোষিত ছুটি। ছুটির একটা অ্যাপ্লিকেশন হয়তো কাল জমা দেয়া যাবে অফিসে যাবার পর। তবে তার আগেই এখন নিশ্চয়ই অফিসে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে তাকে নিয়ে। রিটায়ারমেন্টের আর মাত্র একবছর বাকি। এসময় এসে এত ঘন ঘন ছুটি নেয়াটা কেউ ভালো চোখে দেখেন না। সবার ধারণা, রিটায়ারমেন্টের আগের বছর মানুষ অফিসের কাজে অতি উৎসাহী হয়ে উঠবে। সারাদিন অফিসের কাজ নিয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করবে। ছুটি তো দূরের কথা, অফিস টাইম শেষ হবার এক মিনিট আগেও অফিস থেকে বেরোবে না। যাতে করে অফিস কর্তৃপক্ষ তার কাছে খুশি হয়ে তার চাকরি আরো কয়েক বছর এক্সট্যান্ড করেন। এখানে বয়সটা যেন কিছুই না, স্বার্থই আসল। স্বার্থের কারণে একটা মানুষ যতই বয়স্ক হোন না কেন ছোটাছুটি করবেন, শরীর খারাপ হলেও অফিসে যাবেন, সবাই এটা কল্পনা করতেই ভালোবাসে। অন্যথায়, তার আর চাকরি করবারই দরকার নেই, তাকে বাতিল করে দেওয়া হোক। মানুষ নিজের স্বার্থে ঘা লাগলে যেমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তেমনি অন্যের স্বার্থে ঘা লাগতে দেখলে হয়ে ওঠে সমালোচক।
লেখিকা : সাদিয়া শাহরিণ শিফা
পর্ব : ০১
রান্নাঘরে থেকে গুণগুণ শব্দে গান ভেসে আসছে ডাইনিংয়ে। সাথে খাবারের ঘ্রাণে ম ম করছে পুরো বাসা। আব্দুর রহমান সাহেবের এই মুহূর্তে খুব বেশি মনে পড়ছে আত্রলিতার মায়ের কথা। নিজের স্ত্রীকে তিনি সবসময় রান্না করতে করতে গুণগুণ করতে শুনেছেন। এ নিয়ে খাবার টেবিলে প্রায়শই তর্ক বিতর্ক হতো। তাও। বরং ভালো ছিল। কথা কাটাকাটির একটা ব্যক্তিগত মানুষ ছিল। যার সাথে এমনিতেও তর্কে জড়িয়ে মনের ভাবটা বের করে আনা যেত। বেশ হালকা লাগতো তখন। বৃদ্ধ হলে মানুষ অসহায় হয়, তবে সবচেয়ে অসহায় হয় স্ত্রী বিয়োগে। আত্রলিতাও ছোটবেলা থেকেই যেন তার মায়ের আয়না। হাঁটাচলা, কথা বলা, ঠোঁট বাঁকিয়ে তর্ক করা, রান্নাঘরে গুণগুণ সবকিছুই এক। এমনকি চেহারার আদলও দিনদিন হুবহু মিলে যাচ্ছে। কোমড় ছাড়ানো ঘন কালো চুল, টানটান পেন্সিলে আঁকা মুখাবয়ব, সবকিছু। নিজের মেয়ের দিকে তাকালেই আব্দুর রহমান সাহেবের মনে পড়ে তার কিশোরী স্ত্রীর কথা। মায়ায় ভরে যায় তার দুই চোখ। তবে সেই মায়া সে মুখে ফুটতে দেন না। হৃদয়ের এক কোণে জমিয়ে রাখেন।
অহম চেয়ার টেনে বসলো বাবার পাশে। শব্দে সংবিৎ ফিরলো রহমান সাহেবের। ছেলের দিকে তাকিয়ে একটু কড়া স্বরেই বললেন,"এখনও খাবার আসেনি। কয়টা বাজে খেয়াল আছে কারো? ফুলবুয়া কই? রান্না কি হয়নি!"
চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্কা একজন বৃদ্ধা হুরমুর করে রান্নাঘর থেকে ঢুকলেন। ঘোমটা টানতে টানতে বললেন,"খালু রান্না অইছে। আতু মায় আইজ রান্না করছে। এর লাইগা এট্টু দেরি। আনতাছে"
রহমান সাহেব ভ্রু কুঁচকে কড়া স্বরে বললেন," তুমি জানো না ও অসুস্থ? ওরে রান্নাঘরে যেতে দিলে কেন? তোমারই তো রান্না করবার কথা। না কি?''
প্রতিবার মেয়ে রান্নাঘরে ঢুকলে ফুলবুয়াকে এমন করে একদফা শাসায় রহমান সাহেব, অতঃপর মেয়ের রান্না অত্যন্ত তৃপ্তি নিয়ে খান।
ফুলবুয়া ইতস্তত করে কিছু বলার চেষ্টা করছিল, তার আগেই একটা সিরামিকের প্লেট ভর্তি সরষে ইলিশ এনে খাবার টেবিলে রাখলো আত্রলিতা। তারপর বয়স্কা মহিলার দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে বললো," ফুলবুয়া, তুমি যাও, রান্নাঘর থেকে খিচুড়ির ডিশটা নিয়ে আসো। আর লেবু আছে না? লেবু কেটে দিও একটা, প্লিজ"
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।
খাবারের এই আয়োজন দেখে অহম তো যারপরনাই খুশি। হড়বড় করে বললো," তুমি প্রতিদিন রান্না করলে কত ভালো হতো আপু! ফুলবুয়ার ওই এক শাক তরকারি রান্না আর ভালো লাগে না।"
একটু হেসে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আত্রলিতা। ওর প্লেটে খাবার বেড়ে দিল। বাবার প্লেটে খিচুড়ি তুলে দিতে দিতে বললো,"তোমার জন্য একটু কালোজিরা ভর্তা করলাম বাবা। দিই একটু?"
কড়া গলায় রহমান সাহেব বললেন "দাও, তবে আমি তোমাকে রান্নাঘরে যেতে বারণ করি, চুলার কাছে যেতে বারণ করি। তুমি আমার কোনো কথা শুনবার প্রয়োজন বোধ করো না। এরপর থেকে আর রান্নাঘরে ঢুকবে না"
"জ্বি আচ্ছা" প্রতিবারের মতই একটা ক্ষীণ উত্তরেই ব্যাপারটা এখানে শেষ হলো। অহম শুধু বোনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। ও জানে আত্রলিতা রান্নাঘরে ঢুকবেই আর ঢুকলেই সে তার বোনের হাতের মজার মজার রান্না খেতে পারবে।
ফুলবুয়াকে খাবার দিয়ে এসে চেয়ার টেনে বাবার আরেক পাশে বসলো আত্রলিতা। মাথা নিচু করে সে খাচ্ছে।
খাবার মুখে তুলে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো রহমান সাহেবের। চোখভর্তি জল সন্তর্পণে বেরিয়ে আসা থেকে আটকালেন তিনি। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষকে কঠিন হতে হয়, সবার ভালোর জন্য। সহজ হওয়ার অনুমতি ভাগ্য তাদের দেয়না।
No comments