সত্যের শহরে মিথ্যে প্রেমিক
সত্যের শহরে মিথ্যে প্রেমিক
আহসান হাবীব রকি
বসন্তের সন্ধে। শীত পুরোপুরি কাটে নি আবার গরমটাও পুরোপুরি নামে নি...লেপের নিচে পুরো শরীরটা ঘামে ভিঁজে গেছে। দু'চোখ খুলেই গায়ের উপর থেকে লেপটা সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লো "ইবু। বেলা হোক আর অবেলা-ই হোক ঘুমিয়ে পড়াটাও ইবুর কাছে অত্যন্ত ভাগ্যস্কর বিষয়। তবে জেগে উঠেই তারাহুরো করে ফ্রেশ হয়ে কপড় বদলেই সিড়ি বেয়ে সাততলা নেমে রাজপথজুড়ে দ্রুত হাটা দিয়ে দিলো সে...
কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো - সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও মাফলারটা নিতে ভুলে গেছে ইবু। কি আর! অমনি উল্টো দিকে হাটা দিয়ে রুমে গিয়ে গলায় ধূষর নীল রঙের মাফলারটা জড়িয়ে আবারো রাজপথে ধরে হাটতে শুরু করলো সে...
মাঝপথে এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা-
আরে! ইবু যে...এত তাড়া কিসের? কই যাওয়া হচ্ছে, হ্যাঁ?
-কই আবার, জানিস তো "নন্দীতা"-র সাথে দেখা করার না থাকলে আমি তো এত দ্রুত পায়েচারি করে কোথাও যাই না। ব্যাচারি অনেকক্ষণ ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সন্ধেবেলা অকারন-ই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম, বড্ড দেরি হয়ে গেলো ঘুম থেকে উঠতে। নন্দীতা যে পরিমান রাগী...জানি না আজকে আমার কপালে কি যে আছে! থাক রে আসি..
আরে হ্যাঁ, দাড়া। তোর কাছে খুচড়ো ১০০ টাকা থাকলে দে তো ;আমার কাছে না "১০০০" টাকার নোট। কয়েকটা রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে গিয়ে অভিমান ভাঙ্গাতে হবে মহারাণীর। ব্যাটা পাঁজি ফুলের দোকানদারগুলো আমাকে খুচরো দিতে চায় না। পরে একসময় তোর টাকা ফেরত দিয়ে দেবো, কেমন?
আর তোর টাকা ফেরত! মানিব্যাগে মনে হয় ১০০টাকার কয়েকটা নোট আছে, যা নিয়ে যা তারাতারি। ভালো থাক, কেমন! যা তারাতারি যা, আর থামিস না। টা টা...
ফুলের দোকান থেকে রজনীগন্ধার কয়েকটা স্টিক নিয়ে গিয়ে অবশেষে ইবু তার মহারানী নন্দীতার সামনে হাজির...
-আহারে, আমি তো ভাবলাম তুমি বোধ হয় আমার অপেক্ষায় থাকতে-থাকতে রেগে আগুন হয়ে আছো।
এখন তো দেখছি, তুমি এই চাঁদনী রাতে একা একা বসে জোসনা উপভোগ করছো। উল্টো আমি-ই শহরের অলি-গলি আর জ্যামে পড়ে আধামরা হয়ে গেছি। যাই হোক, মহারাণী...রাগ হও আর নাই বা হও "এই নাও তোমার রজনীগন্ধা"
হ্যাঁ, দাও...তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তুমি হাটাপথে অনেকটা ঘামছো। গলা থেকে মাফলারটা নামিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়ে তো আসতে পারতে, তাই না! এই আবহাওয়াতেও কি গলায় চাদর মুরিয়ে নিয়ে ঘুরতে হয়? আর হ্যাঁ, আমি কি তোমাকে তাড়া দিয়েছি আদৌ! না কি অভিমান করেছি!
তবে এখন সত্যি বলছি, তোমাকে দেখে-বড্ড রাগ করতে আর অভিমান করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।
-গুস্তাখি মাফ করুন মহারানী নন্দীতা মহাশয়া। আপনার এই প্রেমিক আর কখনো এমন গুস্তাখি করার সাহস করবে না।
থাক, এখন আর এসব বাদশাহী নাটকের ডায়লোগ ডেলিবারি দিতে হবে না। না জানি কি কপালে যে তোমার মত মানুষের প্রেমে পড়ছিলাম, কে জানে!
একা-একা চাঁদটাকে দেখে কেমন যেন অসহায় লাগছিল। যাই হোক, তোমার বা'হাতটা দাও ; দেখো- "এই তো তোমার জন্য বকুলফুল কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি"। পাশে বসো। জানোই তো, তোমার কাঁধে মাথা না রাখলে কি আর এই চাঁদনি রাতটা ভালো লাগে! বসো, আজি অনেক গল্প আছে তোমাকে জানানোর.. আমিও কথামত বসে পড়লাম।
চোখের পলকেই যেন ভোর হয়ে এলো। মাথার উপর চাঁদ আর ক্রমাগত বেড়ে ওঠা সূর্যটাকে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। চোখ লেগে গেছিলো বোধ হয়..চোখ খুলে দেখি নন্দীতা নেই আমার আশে-পাশে কোথ্থাও। মেয়ে টা যে কি, দিনের আলোয় সে যে আমাকেও দেখা দিতে চায় না। আমি গা'মুড়িয়ে হামি ছড়াতে-ছড়াতে দেখছি...কবরস্থানের পুরোতন দিকটায় অন্নেক মানুষজন ভীর জমাচ্ছে। নতুন কারোর জন্য বোধহয় কবর দেয়ার ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। বুঝি না, যবে থেকে নন্দীতাকে এই কবরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে তবে থেকে এখানে আমাকে দেখলে লোকজন কেমন যেন "পাগল-পাগল" মনে করে।
আমি আর তাদেরকে বোঝাতে পারি না, নন্দীতা রোজ রাতে আমার সাথে দেখা করে। আমার সাথে গল্প করে, অভিমান করে, পছন্দের রজনীগন্ধা ফুল নেয় আমাকে আমার বুকপকেট ভর্তি বকুলফুল এনে দেয়। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে...তবে আগের মত করে আর টনসিলের ঔষধ আনতে বলে না। অামার গলা থেকে মাফলারটাও আর গলায় বেঁধে নেয় না। প্রশ্ন করলেই বলে...এখন না-কি আর ওর শীত করে না, গলায় টনছিলের ব্যাথাটাও আর করে না। নন্দীতা বলেছে, মৃত মানুষদের না-কি অসুখ করে না,বুকে ব্যাথা করে না। আমিও মাঝে-মাঝে ভাবি ''মরে" যাই, তাহলে অন্ততো দিনের বেলা নন্দীতাকে দেখতে না পারার ক্যান্সারের ব্যাথাটা আর থাকবে না। হায়রে কপাল , নন্দীতা তো আমার জন্য সেই সুযোগটাও আর রাখে নি...বাসার ছাদে একজোড়া টিয়ে পাখি আর একগা'দা গোলাপের গাছ রেখে গেছে। আমি না থাকলে দায়িত্ব নিয়ে গোলাপের গাছগুলোতে পানি দেবে এমন বিশ্বস্ত কেউ আর নেই। টিয়েপাখি গুলোকে সময় মত খেতে দেবে এমন কেউ-ও তো নেই। কি আর নিরুপায় হয়ে আমিই এসবের দেখভাল আর পরিচর্যা করছি। নন্দীতার সাথে কথা হয়েছে- যেদিন এসব দায়িত্ব-কর্তব্য আর থাকবে না সেদিন না-কি আমিও মুক্ত ; চাইলেই নন্দীতার সাথে দিন-রাত দেখা করতে পারবো, কথা বলতে পারবো,ভালোবাসতে পারবো।
ভোর হয়ে গেছে, যাই টিয়েগুলোকে মরিচ আর গোলাপের গাছগুলোতে পানি দিতে হবে। নইলে আবার রাতে অকারনেই নন্দীতাকে মিথ্যে বলে সাজা পেতে হবে। মিথ্যে বলাটা আসলেই বোধহয় খুব খারাপ কাজ, নন্দীতা মোটেও এসব পছন্দ করে না। আমার বলা মিথ্যের কারনেই নন্দীতা সুইসাইড করেছিল। তার সাজাস্বরূপ সারটাদিন নন্দীতাকে খুঁজে-খুঁজে হয়রান হলেও নন্দীতা আর দেখা দেয় না। আর এখন তো, নন্দীতার প্রিয় জোস্না রাতেও হাতে-হাত রেখে বসে থাকা অবস্থায় যদি ভুলেও/ঠাট্টাতেও কখনো মিথ্যে বলি তাহলে কেমন করে যেন নন্দীতা গায়োব হয়ে যায়। মাঝরাতে নন্দীতার আচম্কাই হারিয়ে যাওয়ার থেকে ভয়াবহ সাজা বোধহয় আমার জীবন আর নেই। সুবোধে আমি বরং কেটে পড়ি আর রাত ঘনিয়ে আসার প্রার্থনা করি। হ্যাঁ, নন্দীতার সাথে আমার তো আরো অনেক-অন্নেক কথা বাকী আছে...
-০-
No comments