অভিশাপের নীল চাষ এখন হতে পারে আশীর্বাদ
নীল চাষ, নীল কর ইত্যাদি এক সময় একটি আতঙ্কের বিষয় ছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ব্রিটিশরা এক সময় বাঙালি কৃষকদের নীল চাষ করাতে বাধ্য করত। ইতিহাস থেকে জানা যায় সপ্তদশ শতক থেকে এ অঞ্চলে নীল চাষের গোড়াপত্তন হয়। কারণ এখানকার মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু নীল চাষের জন্য খুবই উপযোগী ছিল। তখন ব্রিটিশ শাসকচক্র বাংলার কৃষকদের দিয়ে নীল চাষ করিয়ে নিত। কিন্তু এর লাভের বেশির ভাগ নিয়ে যেত বেনিয়ারা। তখন কৃষকরা লাভের বদলে দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হতো।
যখন দিনের পর দিন লাভের পরিবর্তে লোকসান গুনতে হতো, সে জন্য বাংলার কৃষককুল হতাশা থেকে নীল চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তারা আর তখন নীল চাষ করতে চায়নি। সে জন্য তাদের অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এভাবে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ চলতে চলতে অষ্টাদশ শতকের দিকে এসে আস্তে আস্তে বাংলার কৃষকরা বিদ্রোহ করতে শুরু করেছিলেন। নীল করদের বিরুদ্ধে এভাবে বিদ্রোহের মাধ্যমেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। তাই তো সেই সব ঘটনাকে উপজীব্য করে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রচনা করেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’।
নীল আসলে কী? দীর্ঘদিনের ব্যবধানে এখন হয়তো নীল সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু ভুলে গেছি। নীল হলো আসলে একটি কৃষি ফসল। ইংরেজিতে একে বলে ইন্ডিগো এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো ওহফরমড়ভবৎধ ঃরহপঃড়ৎরধ. নীলের চাষাবাদ পদ্ধতি খুব সহজ। বাংলাদেশের আবহাওয়া নীল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। যেকোনো ধরনের উঁচু মাটিতেই নীলের আবাদ করা সম্ভব। তবে বেলে মাটিতে যেখানে অন্য তেমন কোনো ফসল হয় না সে সব স্থানেও নীল চাষ করা সম্ভব। তা ছাড়া নীল চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করা খুবই সহজ। আবার দেখা যায় খেতের আইলে, পুকুরের পাড়ে, নদীর ধারে, রাস্তা-ঘাট ও মাঠের পাশেও বিনা চাষে নীল আবাদ করা যায়।
নীল গাছের গড় উচ্চতা দেড় থেকে দুই মিটার। এটি লিগুমিনাস প্রজাতির ফসল। দেখতে অনেকটা পাটগাছ কিংবা মেহেদিগাছের মতো। তবে নীলগাছে প্রচুর পরিমাণে নীলাভ-সবুজ ব্রাঞ্চিং বা ডাল-পালা থাকে। আর এসব ডাল-পালায় অনেক পাতা উৎপন্ন হয়। এসব পাতার নির্যাস থেকেই আসলে প্রাকৃতিক রং নীল উৎপন্ন হয়। গাছের পাতা থেকে নির্যাস হিসেবে নীল সংগ্রহের পর যেসব পাতা থাকে সেগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন পাওয়া যায়। সেসব পাতা দিয়ে তখন সার তৈরি করা হয় যা দ্বারা ইউরিয়া সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে লাভবান হওয়া যায়।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় মার্চ মাসে নীল রোপণ করা হয়। রোপণের তিন মাস পর থেকে নীলগাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে নীল আহরণ করা যায়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস অবধি নীলগাছে ফুল, ফল হয়। সেখান থেকে ফুল এবং ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে সেই বীজ থেকে চারা এবং সেই চারা থেকেই নীলগাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই নীল চাষের জন্য উপযোগী, তবে এক সময় সারা বাংলায় নীল চাষ হলেও এখন আর বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নীল চাষ হচ্ছে না। কিন্তু প্রায় একযুগ ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে ক্ষুদ্র পরিসরে নীল আবাদ হচ্ছে। সে সব স্থানের মধ্যে যশোর এবং রংপুর অন্যতম।
২০০৬ সাল থেকে রংপুরের কয়েকটি ইউনিয়নে নীল আবাদ হয়ে আসছে যার সফলতার কারণে তা এখন অনেকটাই সম্প্রসারিত হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন সে সব এলাকার কৃষক। আগেই বলেছি লিগুমিনাসজাতীয় একটি ফসল হওয়ার কারণে এর আবাদের ফলে জমিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কিছু নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে থাকে। এতে সে সব জমিতে ইউরিয়া সারের চাহিদা কম লাগে। তা ছাড়া বাড়তি ডাল-পালা লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ নীল আবাদে শুধু যে নীলই পাওয়া যায় তাই নয়। এর থেকে উপজাত হিসেবে নাইট্রোজেন, লাকড়ি, বীজ ইত্যাদি পাওয়া যায় যা থেকেও কৃষক সমানভাবে লাভবান হয়ে থাকে।
এক সময় নীল নিয়ে কেন এত আগ্রহ ছিল তা আমরা একটু আলোচনা করলেই বোঝা যাবে। কারণ প্রাকৃতিক রং হিসেবে নীলের জুড়ি ছিল না। তা ছাড়া এ অঞ্চলের নীল থেকে যে মানসম্পন্ন নীল পাওয়া যেত তা আর কোথাও হতো না। আর বর্তমানে যেমন কৃত্রিম সবকিছু পরিহার করে মানুষ আবার সেই প্রাকৃতিক জিনিসপত্রের দিকে ঝুঁকছে। সে জন্য আবারও বাংলাদেশের নীলের চাহিদা দেখা দিয়েছে। তাই এর আবাদও আবার সম্প্রসারণের দিকে এগোচ্ছে। কারণ আমরা দেখছি বিভিন্ন কৃত্রিম তন্তু বাদ দিয়ে যেমন পাট ও পাটজাত তন্তুর কদর বাড়ছে। ঠিক তেমনি কৃত্রিম বিভিন্ন রঙের বদলে প্রাকৃতিক নীল রঙের জন্য নীল চাষের গুরুত্ব বাড়ছে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪ এ শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন বই "মানুষ"। পাওয়া যাচ্ছে অনার্য, ৪৯৮-৫০১ নং স্টলে। অনলাইনে অর্ডার করতে কল করুন 01745676929 নাম্বারেবাংলাদেশে রংপুরের কয়েকটি ইউনিয়নে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনের সহায়তায় আবারও নীল চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে। সেখানে প্রতি বছর কমপক্ষে এক হাজার কেজি নীল উৎপাদিত হচ্ছে। তাতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিও করছে সেসব নীল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে নীল রপ্তানি করে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার (৫০ লাখ টাকা) বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনটি হলে কৃষিতে রপ্তানির তালিকায় আরেকটি সম্ভাবনাময় অপ্রচলিত কৃষিপণ্য যুক্ত হলো যার মাধ্যমে আগামীতে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
আমাদের দেশের উৎপাদিত ভালো মানের নীলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের আরও অনেক দেশে। একমাত্র ভারতেই প্রতি বছর নীলের চাহিদা হলো ২৫০ মেট্রিক টন। কাপড়ের মধ্যে রং লাগাতেই এসব নীল বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ হিসেবে জানা গেছে, কৃত্রিম রং ব্যবহারের ফলে নাকি মানুষের গায়ে ক্যানসারের মতো জটিল রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাই প্রাকৃতিক রঙের দিকেই ঝুঁকছে আধুনিক মানুষ। তা ছাড়া নীল চাষের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ এক সময় উত্তরবঙ্গে যে মঙ্গা নামক অভাব জেঁকে বসত এখন তা আর নেই। সেসবের একটি অন্যতম কারণ হলো- জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তাদের হাতে কাজ সৃষ্টি হওয়া। সেসব কাজের অনেকটাই সৃষ্টি করেছে নীল চাষ।
জানা গেছে, রংপুর জেলার সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে এখন নীলের আবাদ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এগুলো হলো- রাজেন্দ্রপুর, খালেয়া গঞ্জিপুর, মমিনপুর, চন্দনপাঠ ও হরিদেবপুর। এ ছাড়া গঙ্গাচড়া উপজেলায়ও কিছু পরিমাণে নীলের আবাদ হয়। ২২ থেকে ২৫ ইঞ্চি পরিমাণ পর্যন্ত ডাল কেটে সংগৃহীত ও উৎপাদিত প্রতি কেজি নীল গাছের পাতা ৩০০ টাকা দরে এবং উৎপাদিত বীজের প্রতিকেজি ১০০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারেন কৃষকরা। এসব নীল আবাদ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় মাঠকর্মীরা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছেন। এটি একটি পরিবেশসম্মত কৃষিব্যবস্থা। কারণ আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি তামাক একটি কৃষিপণ্য কিংবা কৃষি ফসল হলেও সেটি পরিবেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। কিন্তু নীল সম্পূর্ণরূপে একটি পরিবেশসম্মত কৃষি ফসল।
যেহেতু এখন নীল ইউরোপসহ বহির্বিশ্বের অনেক দেশে প্রচুর চাহিদার একটি পণ্য। কাজেই এখন তা দিয়ে একটি মধুর প্রতিশোধও নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এক সময় বাংলার কৃষককে শোষণ করে অর্থ পাচার করত ইংলিশ নীল করেরা। কিন্তু বৈধভাবেই নীল উৎপাদন করে সেসব দেশে রপ্তানি করে সেখান থেকে নীলের বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই হলো মধুর প্রতিশোধ। কারণ তাদের কাছে এখন যেমন তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত করেছে। কাজেই এক সময় অত্যাচারের মাধ্যমে পাচার করার সম্পদ নীল তাদেরই আমাদের দেশ থেকে চরমমূল্যে কিনে নিতে হবে- তা তো সত্যিই একটি মধুর প্রতিশোধ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এভাবেই প্রতিক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তেমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments