ভাষা আন্দোলন: বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী অবদান
ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে একটা অগ্রণী অবদান রয়েছে, সে অবদানই স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা করেছিল। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বইপত্রে অনেক তথ্য বাদ দেয়া হয়েছে বা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির ওপর সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু তাদের সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের অগ্রসারিতে। আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭-এ ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে, ১৯৪৮-এ রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রাখে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর কাছে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ করে গেছেন এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের দাবির কথা বলে গেছেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পরপর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে গোড়া থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭-এর ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। এ সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক `ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রস্তাবগুলো ছিলÑ ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ ভাষার দাবি এভাবে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল (ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা: গাজীউল হক; ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র; ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)।
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক নতুন বই "মানসিক স্বাস্থ্য"। অর্ডার করতে 01745676929 নাম্বারে আপনার নাম, ঠিকানা, কনটাক্ট নাম্বার লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠান।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ফিরে আসার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম জীবনীকার অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান এই মজলিসকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহুকাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: মযহারুল ইসলাম; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৩; পৃ. ১০৪)
১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে সমকালীন রাজনীতিবিদরাসহ ভাষা আন্দোলনের ১৪ জন নেতা সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেন। এসব দাবির মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল নামে একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। এটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এ ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন এটাতে অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।
১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে উপস্থাপিত ১০ দফা দাবির অন্যতম ছিল, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হোক। একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের আহ্বানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন ধর্মঘট চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করেন। এ ধর্মঘটেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন শেখ মুজিব। এ প্রসঙ্গে ড. মযহারুল ইসলাম লিখেছেন, এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। (ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯-২০)
সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শেখ মুজিবও আন্দোলনে শরিক হন এবং যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯৪৮-এর ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এ সভায় অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশ গুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের উপস্থিতিতে গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তাঁর ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুদূরপ্রসারী।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় মন্তব্য: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। (দৈনিক আজাদ; ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১)। রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৪৯-এ ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয় ১৯৭২-এর ১৬ ডিসেম্বর। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় লিখিত সংবিধান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এ সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে অগ্রদূতের ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ।১৯৭৫-এর ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এতে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে, এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’
বাংলা ভাষা আজ দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। আজ পৃথিবীর সব রাষ্ট্র শুধু যে দিবসটি পালন করছে তা-ই নয়, বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মাতৃভাষার জন্য বাঙালির ঐতিহাসিক আত্মত্যাগকে। বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে মাতৃভাষার জন্য সেদিন যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, সে চেতনায় ধাবিত হয়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার এই ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা।
বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই স্বীকার করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকৃতি বা অবমূল্যায়ন মানেই আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সর্বোপরি আমাদের জাতিসত্তা ও অস্তিত্বকেই অস্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু আজ আর এ পৃথিবীতে নেই, কিন্তু বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে যতবার দৃষ্টিপাত করা হবে, ততবার এই মহান নেতা আমাদের স্মরণে মননে ফিরে ফিরে আসবেন। মহান একুশের ৬৯তম বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি বাংলা ভাষার আন্দোলনে ও প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় অবদানকে।
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments