কাউনিয়া মিয়া বাড়ি
কাউ নিয়া, বেতাগী, বরগুনা।
বরগুনাতে কি জমিদার বাড়ি আছে এটা অনেকের প্রশ্ন।এই প্রশ্নটার অনেক কারন আছে , এই অঞ্চল মূলত নদী এবং সাগর কেন্দ্রীক যে কারনে এই অঞ্চল একটা সময় ঘন বনাঞ্চল ছিলো।বেতাগিতে ঐতিহাসিক বিবিচিনি মসজিদ ছাড়া তেমন কোন ঐতিহাসিক স্থাপনা এই বরগুলা জেলাতে নেই এটা অনেকের ধারণা।তবে সবাইকে জানাতে চাই বরগুনাতে ৩০০ বছরের পুরাতন এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি আছে।এই জমিদার বাড়ির নাম কাউনিয়া জমিদার বাড়ি বা কাউনিয়া মিয়া বাড়ি। স্থানীয় ভাবে এটি এখন কাউনিয়া মিয়া বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
বর্তমানে এই বাড়িটি দুটি ভাগে বিভক্ত ,দুটি বাড়িই একই প্যার্টানে নির্মাণ করা হয়েছিলো।এবার এই বাড়ির খুটিনাটি ইতিহাস জানানোর একটু চেষ্টা করা যাক।মধ্যযুগের শেষভাগ থেকে ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার ইতিহাসে বাকেরগঞ্জ একটি আলোচিত জেলা।এ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তত্কালীন প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকের খাঁর নাম। তার পুরো নাম মির্জা আগা মোহাম্মদ বাকের। পারস্য থেকে বাংলায় আসা এ অভিজাত সরকারি কর্মকর্তা বুজুর্গ উমেদপুর ও সলিমাবাদ পরগনার জমিদারি লাভ করেছিলেন। মোগল আমলে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা নিয়ে পরগনা দুটি গঠিত ছিল। নবাবি আমলে আগা বাকের বুজুর্গ উমেদপুর পরগনার দায়িত্ব লাভ করেন। শ্রীমন্ত নদীর তীরে তিনি একটি বন্দর তৈরি করেন বা অবস্থিত বন্দরে বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বাণিজ্যকেন্দ্রটি কালক্রমে বাকেরগঞ্জ নামে পরিচিত হয়।এই আগা বাকের খানের নায়েব ছিলো আবি আবি আবদুল্লাহ খান আর সেই নায়েব আবি আবদুল্লাহ খানের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে এই কাউনিয়া জমিদার বাড়ি বা কাউনিয়া মিয়াবাড়ি।আবি আবদুল্লাহ খাঁনের পূর্ব পুরুষ কুতুব খাঁন সুজাবাদ থেকে কাউনিয়ায় আগমন করেন বলে জানা যায়।অনেকে বলে থাকেন বুজুর্গ উমেদপুরের মালিকানা তারা পেয়েছিলেন এটি আসলে ভুল ধারনা। বুজুর্গ উমেদপুরের অনকগুলো তালুক ছিলো আনুমানিক ৪০০/৫০০ তারমধ্যে কিছু তালুকের মালিকানা লাভ করেছিলো এই মিয়াবাড়ি।
ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক ইতিহাস চলে আসে তাই আপনাদের বুজুর্গ উমেদপুর সম্পর্কে একটু ধারনা দিয়ে রাখি-
সম্রাট আওরঙ্গজেব মগ-পর্তুগীজদের সাথে যুদ্ধে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য চন্দ্রদ্বীপ পরগণা ও সরকার বাজুয়া হতে নতুন একটি পরগণা সৃষ্টি করে শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ উমেদকে প্রদান করেন। তাঁর নামে পরগণার নাম হলো বুজুর্গ উমেদপুর। বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, বেতাগী, আমতলী, বরগুনা, পাথরঘাটা, বামনা প্রভৃতি এ পরগণার অন্তর্গত ছিল। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর শাসনের শেষ ভাগে আগাবাকের খান বুজুর্গ উমেদপুর পরগণা লাভ করেন। ১৭৫৩ খৃৃস্টাব্দে আগাবাকের নিহত হলে রাজবল্লভ বুজুর্গ উমেদপুর দখল করে নেন। রাজবল্লভের প্রথম কাছারি বারৈকরণে ছিল। তার পুত্র গোপাল কৃষ্ণ ঝালকাঠির সুতালরীতে কাছারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন তার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর পীতাম্বর সেন জমিদারী পরিচালনা করেন। তার সময় উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি কালেক্টর মিঃ মেসি সরকারের পক্ষে বুজুর্গ উমেদপুর পরগণা নিলামে ক্রয় করেন। ১৮০১ খৃৃস্টাব্দে জমিদারী বিক্রির পর অধীনস্থ তালুকগুলো বিক্রি হয়। তখন তালুকের সংখ্যা ছিল ৫৯৪টি। ১৮৭৬ খৃৃস্টাব্দে পৃথক তালুকের সংখ্যা ছিল ৪০৭টি এবং রাজস্ব ছিল ২,৬৫,৮৯৫ টাকা।
বুজুর্গ উমেদপুর পরগণার জমিদার পরিবারসমূহ: ১. রাজবল্লভ পরিবার, ২. শিবপুর তালুকের ফ্রেরাফেলডা আলজোস পরিবার, ৩. বামনার সৈয়দ পরিবার, ৪. বামনার চৌধুরী পরিবার, ৫. পাথরঘাটার চৌধুরী পরিবার, ৬. নিয়ামতির সিকদার পরিবার, ৭. চালিতাবুনিয়ার মির পরিবার, ও ৮. বিঘাইর মিয়া পরিবার।
এবার আবার এই মিয়াবাড়িতে আসা যাক, আমি প্রথমে বলেছিলাম বরগুনায় নাকি জমিদার বাড়ি নাই এটা অনেকের ধারনা , এখন আপনারা দেখেন বুজুর্গ উমেদপুরের তালুক গুলোর কতজন মালিক ছিলো। কালের পরিক্রমায় এসব সবই এখন হারিয়ে গেছে টিকে আছে কিছু পরিবার এবং তাদের প্রভাব তাদের মধ্যে এই কাউনিয়া মিয়াবাড়ি অন্যতম।
আরো পড়ুন কর্মচারী থেকে জমিদার হয়ে উঠার গল্প
কাউনিয়া মিয়া বাড়ি্র অবকাঠামো-
এই দুটি হিস্যায় হয়তো বিভক্ত ছিলো আসলে এ সম্পর্কে আমি তেমন জানতে পারিনি, কিন্তু আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। প্রথম হিস্যা এবং দ্বিতীয় হিস্যা ৫মিনিট হাটার দূরত্ব অবস্থিত। আমি এখন আসলে হিস্যা হিসেবে দেখাবো না আমি বড় অংশ এবং ছোট অংশ হিসেবে আপনাদের সামনে তুলে ধরতেছি।
ছোট অংশ- এখানে একটি মসজিদ একটি বড় পুকুর এবং একটি সীমানা প্রাচীর ঘেরা বাড়ি রয়েছে। বাড়ির ভিতরে এখন কেউ থাকে বলে মনে হয় না। ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীর সাথে ভারতীয় স্থাপত্য শৈলীর একটা মিশ্রনে এই বাড়িটি তৈরি। এই বাড়ি থেকে একটু সামনে ছোট একটি খাল পেরিয়ে মূল বাড়িটি অবস্থিত।এই বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে একটি মসজিদ পড়বে, সেই মসজিদের পাশেই বিশাল ঘাট বাধানো পুকুর।এবার মূল বাড়ি নিয়ে কথা বলা যাক, বাড়িতে ঢুকতে প্রথমেই বৈঠক খানা, স্কুল ঘরের মত বিশাল এক বৈঠক খানা, সেই বৈঠক খানার ঠিক মাঝ দিয়ে যাওয়ার রাস্তা সেই রাস্তা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়, বৈঠক খানার পরই হলো সিং দরজা, সেই দরজা পেরিয়ে আসলে মূল বাড়িতে প্রবেশ করতে হতো।বাড়িতে প্রবেশ করলে দেখা যাবে কয়েকটি ঘর যার মধ্যে কয়েকটি এখনো ব্যবহার হচ্ছে বাকি দুটো ঘরের অবস্থা খুবই শোচনীয়, এই ভবনগুলো নাকি এই মিয়াবাড়ির প্রথম দিকের ঘর, এই ঘর গুলো ব্রিটীশ এবং ভারতীয় স্থাপত্য শৈলীর সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছে।
এই হচ্ছে এই জমিদার বাড়ির টুকটাক ইতিহাস।
কাউনিয়া,বরগুনা।
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments