গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স
গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স। নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া।
এই নবাব বাড়ি তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত এক ধর্মীয়, রাজনৈতিক, শিক্ষানুরাগী এবং তৎকালীন সেরা মুসলিম পন্ডিত নবাব সৈয়দ শামসুল হুদার বাড়ি।তার পিতা সৈয়দ রিয়াজত উল্লাহ সাপ্তাহিক দূরবীনের সম্পাদক ছিলেন।
সৈয়দ শামসুল হুদা তার নিজ গৃহে পিতার নিকট থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ও ইসলাম বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ঐতিহ্যগত শিক্ষা সমাপনের জন্য হুগলী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। আধুনিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন ও ১৮৮৪ সালে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৮৮৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব ল' ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৮৮৯ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে হতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
সৈয়দ শামসুল হুদা প্রতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে বিংশ শতাব্দীর গুড়ার দিকে তার সমকালীন সময়ের মুসলিম পণ্ডিত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করলেন।
সৈয়দ শামসুল হুদা ১৮৮৫ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন এবং একই বছরে মাওলানা উবাইদুল্লাহ আল উবাইদি সোহরাওয়ার্দী মারা গেলে সৈয়দ শামসুল হুদা আরবি ও ফার্সি বিভাগে অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। পাশাপাশি কলকাতা হাইকোর্ট-এ আইন চর্চা শুরু করেন।
সেখান থেকেই তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৮৮৫ সালে কলকাতা হিন্দু নেতৃবৃন্দ দ্বারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। এই রাজনৈতিক অবকাঠামো ভারতের হিন্দু ও মুসলিম সম্মিলিত ভাবে সকল জনতার জন্য প্রতীকী প্রস্তাব পেশ করে। প্রখ্যাত ভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ - স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আব্দুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলী প্রথমেই তাদের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে, হিন্দু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিভক্তির দিকে এগিয়ে গেলেন। ১৮৯৫ সালে মুসলিম নেতৃবৃন্দ কলকাতা ইউনিয়নের দ্বিতীয় বাৎসরিক সভার আয়োজন করেন। সৈয়দ শামসুল হুদা উক্ত সভায় যোগ দেন এবং বিভক্তির দিকে না গিয়ে সকল জনতাকে এক হওয়ার জন্য আহ্বান করে 'ভারতীয় রাজনীতি এবং মোহাম্মাদ'-এ শিরোনামে বক্তব্য রাখেন। তিনি তার স্পর্শকাতর বক্তৃতায় ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ এবং কীভাবে কংগ্রেসকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা যায় সে বিষয়ে প্রস্তাব রাখেন।বাজেটকৃত বরাদ্দের সমূদয় অর্থ ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার নিকটে অবস্থিত জেলা সমূহে স্কুল, কলেজ, হাঁসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ব্যয় হয় বিধায় সৈয়দ শামসুল হুদা সর্বপ্রথম ১৯০৫ সালে বাজেটের বিরোধিতা করেন এবং সমভাবে পূর্ববাংলার উন্নয়নের জন্য নীতি গ্রহণের সুপারিশ করেন। তিনি এ বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠা করেন যে, এ উন্নয়ন পূর্ব বাংলার মুসলিম জনতার জন্য সুবিধাজনক হবে যদিও উচ্চ বর্ণের হিন্দুগণ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতন ও বিদ্বান হিসাবে সৈয়দ শামসুল হুদা নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন যা তিনি তার নিজের ভাষায় লিখেছেন :
(ইংরেজি)
«I claim that after the creation of the new Province, East Bengal has received a great deal more of personal attention. Before the Partition the largest amount of money used to be spent in districts near Calcutta. The best of Colleges, Hospitals and other institutions were founded in or near about the capital of India. Bengal alone now reaps the benefit of those institutions towards which both the Provinces had contributed. We have inherited a heritage of the accumulated neglect of years and cannot be blamed if [we] require large sums to put our house in order.[
(বাংলা)
«আমি মনেকরি, নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার প্রতি সকলেরই ব্যক্তিগত মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছে। বিভাগপূর্বকালে বিপুল পরিমাণ অর্থ কলকাতার অদূরে অবস্থিত জেলাসমুহে ব্যয় করা হতো। সেরা কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমুহ ভারতের রাজধানী অভ্যন্তরে অথবা তার কাছাকাছি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন উভয় প্রদেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল, বাংলা এখন থেকে একাকী ঐ সকল সুবিধাদি পাওয়ার অধিকারী। আমরা বিগত বছরের সঞ্চিত অবহেলার এক ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারী তাই [আমরা] যদি বড়অঙ্কের অর্থ নিজভূমের উন্নয়নের স্বার্থে রেখেদেয়ার দাবী করি তবে তাতে নিন্দা করার কিছু নেই।
সৈয়দ শামসুল হুদা ১৯০২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি তার সভাপতির বক্তৃতায় 'ঠাকুর ল লেকচার' এ শিরোনামে বক্তব্য রাখেন যা Butterworth & Co,(India) Ltd কর্তৃক The Principles of the Law of Crimes in British India[৪][৫] নামে অনুমোদিত হয়। তিনি জেরেমি বেন্থাম, উয়িলিয়াম অস্টিন এবং উইলিয়াম ব্লেকস্টোনের ব্যাখ্যার আলোকে মৌলিক মতাদর্শের ভিত্তিতে অপরাধ বিষয়ক আইনের সংস্কার আনয়ন করেন। তিনি ১৯০৪ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন। তিনি ১৯০৮ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের 'আইনসভার' এর সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের 'প্রেসিডেন্ট' নির্বাচিত হন। পূর্ববাংলার মুসলিম 'নেতা' হিসেবে ১৯১১ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
সৈয়দ শামসুল হুদা ১৯১২ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত 'গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল' এর সদস্য নির্বাচিত হন।তিনি ১৯১৩ সালে নবাব উপাধিতে ভূষিত হন এবং ১৯১৬ সালে কে.সি.আই.ই উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ১৯১৭ সালে সৈয়দ আমীর আলী পর কলকাতা হাইকোর্টে বাংলার দ্বিতীয় মুসলিম বিচারপতি হিসাবে অধিষ্ঠিত হন।
সৈয়দ শামসুল হুদা ১৯২১ সালে অবিভক্ত বাংলার সংস্কারকৃত লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় মুসলিম প্রেসিডেন্ট হন।
সৈয়দ শামসুল হুদা ঔপনিবেশিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কঠিন সময়কালে বাংলার মুসলমান ছাত্রদের জন্য একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি গ্রাম থেকে আসা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য কারমাইকেল হোস্টেল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাসস্থান সৃষ্টি করেন। ১৮৯৮ সালে এলিয়ট মাদ্রাসা হোস্টেল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সরকারের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ ও নবাব আবদুল লতিফ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট হতে ৫,৪০০ রুপি দ্বারা তহবিল তৈরি করেন। তিনি প্রতিটি বিভাগের মুসলিমদের শিক্ষার জন্য সহকারী পরিচালক পদ সৃষ্টি করেন।
সৈয়দ শামসুল হুদা বাংলা সরকারের নিকট থেকে জমি ক্রয় করে কলকাতায় মুসলিমদের জন্য একটি সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৯০০,০০০ রুপি মঞ্জুর করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হয়। ১৯২৬ সালে যখন আবুল কাশেম ফজল-উল-হক শিক্ষা মন্ত্রী হন তখন উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি তার পৈত্রিক সম্পত্তির উপর ১৯১৫ সালে বিদ্যালয় স্থাপন করেন, পরে তিনি উক্ত বিদ্যালয়টি তার সমবয়সী চাচার নামে উৎসর্গ করে দেন। এটি গোকর্ণ সৈয়দ উয়ালী উল্লাহ হাই স্কুল নামে পরিচিত।এটিই নাসিরনগর উপজেলায় স্থাপিত প্রথম বিদ্যালয় যেখানে হিন্দু ও মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেয়েছিল। তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এর ছাত্রদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে লর্ড রোনাল্ডসে (১৯১৭-১৯২২ সাল) কর্তৃক স্থাপিত হয়। তিনি সৈয়দ শামসুল হুদা-কে আজীবন সদস্য ঘোষণা করেন। সৈয়দ শামসুল হুদার সুপারিশে স্যার এ. এফ. রাহমান কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট মনোনীত করা হয়, তিনি পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়-এ কার্যরত ছিলেন।
হুদা সুধাকর (১৮৮৯), উর্দু গাইড প্রেস এবং মুহাম্মাদান অবজারভার (১৮৮০) জার্নালের অর্থায়ন করেন। ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা মহিলাদের বাংলায় শিক্ষা অর্জনে বাধা দেয়। তিনি বেগম রোকেয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশন প্রজেক্টকে নারী শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য সমর্থন ও উৎসাহ দেন।
No comments