Adsterra

দ্বীপ জেলা ভোলার এক মুসলিম জমিদার বাড়ির ইতিহাস

ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Today Trending News, Today Viral News, Top News, Hot News, bangla news, ইতিহাস,বাংলাদেশ, দ্বীপ জেলা ভোলার এক মুসলিম জমিদার

দ্বীপ জেলা ভোলার এক মুসলিম জমিদার বাড়ির ইতিহাস। বোরহানউদ্দিন, ভোলা।

চার হাজার একর সম্পত্তির জমিদারি,জমিদাররা খুবই সৌখিন ছিলো তারা বাড়িতে হরিণ, ময়ূর পুষতেন আবার অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো এই জমিদার বাড়ির জমিদারগণ।আজ থেকে প্রায় ২৭৫ বছর আগে গোড়াপত্তন হয়েছিলো ঐতিহাসিক এই মুসলিম জমিদার বাড়ির।আরাকান এবং মগ দলদস্যুদের অভয়রণ্য ছিলো দ্বীপময় এই জেলাটি, মানুষ বসবাসের ইতিহাস বেশি দীর্ঘ নয়,১২৩৫ সালের দিকে ই দ্বীপের সৃষ্টি হয় তখন এটির নাম ছিলো দক্ষিণ শাহবাজপুর। মানুষ এই জায়গায় ১৩০০ সালের দিকে চাষাবাদ শুরু করে, আগেরকার মানুষদের মূল জীবিকা ছিলো চাষাবাদ অতএব এ থেকে মনে হচ্ছে ১৩০০ সালের দিকেই এখানে মানুষ বসবাস শুরু করে। আঠারো শতরের দিকে এদি বাকেরগঞ্জ এর মধ্যে ছিলো কিন্তু ১৯ শতকে এটি নোয়াখালীর ভিতর অন্তভূক্ত করা হয় এর কারণ হলো মেঘনা নদীর ভাঙ্গা গড়া।তবে ১৮৬৯ সালে এটিকে বরিশালের মহকুমা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।ভোলার মানুষদের সাথে নোয়াখালী মানুষদের সংস্কৃতি গত অনেক মিল আছে। যাইহোক ভোলার ইতিহাস আমার আলোচ্য বিষয় না এবার মূল টপিকে আসি-
অনেকেই বুঝতে পেরেছেন আমি ভোলার কোন এক জমিদার বাড়ির ইতিহাস বলতেছি।হায়দার মহল বা হায়দার আলী জমিদার বাড়ি । ১৫ একর জায়গার উপর ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের পেট মানিকা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই জমিদার বাড়িটি।তেতুলিয়া এবং মেঘনা নদীর মাঝ বরাবর এক সমতল ভূমিতে নির্মাণ করা হয়েছিলো এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি।ভোলা দ্বীপের গোড়াপত্তনের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক মতবাদ প্রচলিত রয়েছে যাইহোক এ নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না।
১৬২০ খ্রিস্টাব্দে মগরা ঢাকা শহরে ব্যাপক হামলা চালায়। সে সময় সুবাদার ইবরাহিম খান ফতেহজং বীরত্বের সাথে তাদের প্রতিহত করেন। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মগরা ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে বরিশালের শাহবাজপুরে হামলা করে। ইবরাহিম খান দ্রুত তার নৌবহর নিয়ে তাদের আক্রমণ করেন। মগরা পালিয়ে যশোরের দিকে চলে যায় এবং সেখান থেকে প্রায় ১৫০০ নারী-পুরুষকে বন্দী করে। ১৬২১-১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মগ-ফিরিংগিদের হাতে প্রায় ৪২০০০ মানুষ বন্দী হয়। পর্তুগিজরা এদের মধ্যে ২৮ হাজার জনকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে। বাকিদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। ১৬২৫ সালে মগরাজ শ্রীসুধর্ম ঢাকায় আক্রমণ করলে ঢাকার মোগল সুবাদার খানজাদ খান আতংকে ঢাকা ছেড়ে রাজমহলে পালিয়ে যান। মগরা বিজয়ীর বেশে ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। তিনদিন ধরে তারা শহরে চালায় নির্মম লুণ্ঠন ও হত্যা। সুবাদারের প্রাসাদ মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। ফেরার সময় মগদের সঙ্গী হয় অসংখ্য যুদ্ধবন্দী ও বিপুল ধন-সম্পদ।
মগদের আক্রমণে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের লিখেছেন, মগ জলদস্যুদের আক্রমণে সমুদ্র উপকূলীয় অনেক দ্বীপ এখন জনশূন্য। এখন এই সব দ্বীপ দেখলে মনেই হয় না এককালে এখানে লোকালয় ছিল। ধূ ধূ করছে জনমানবশূন্য এসব গ্রাম।
বাংলা থেকে মগদের পুরোপুরি বিতাড়িত করেছিলো শায়েস্তা খান, ১৬৬৫-৬৬ সালে মগদের শক্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তারপরে তারা আর তাদের শক্তি ফিরে পায়নি।
এই ইতিহাসটা জানানোর কারণ হলো- তখনকার শাহবাজপুর ,নোয়াখালী সহ অনেক অঞ্চল লোকশূন্য হয়ে পরছিলো দস্যুদের ভয়ে।ধারণা করা হয় এই অবস্থার পরিবর্তন হয় শায়েস্তা খান বাংলার মসনদে বসার পর।মানুষজন আবার এসব জায়গায় ফিরতে থাকে।এবার হায়দার জমিদার বাড়িতে যাওয়া যাক-
তখন কুমিল্লার জনৈক ইজ্জত উল্লাহ আকন ভোলার স্থানীয় খায়রুল্লাহ বিশ্বাসের মেয়েকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার একমাত্র ছেলে রিয়াজ উদ্দিন আকন তৎকালীন জমিদার তারা প্রসন্ন ভট্টাচার্যের জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব পান। একসময় তিনি প্রচুর জমি ও অর্থ সম্পদের মালিক হন। তিনি ‘জমিদার’ হিসেবে খ্যাতি পান। তার ছেলেই হায়দার আলী। যার নামে ‘হায়দার মহল’। ঐতিহাসিক ভাবে এই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তনের ইতিহাস।
জমিদার বাড়ির গেটে লেখা স্থাপিত বাংলা ১১৫৫ সাল , তাতে ইংরেজি ১৭৪৮ সাল হয়।তখনকার সময় এই অঞ্চলের নাম ছিলো কালীগঞ্জ।রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে ছিলো হায়দার আলী এই হায়দার আলীর নামেই মূলত হায়দার মহল বা হায়দার জমিদার বাড়ি। এই হায়দার আলীর ছিলো ছয় সন্তান। এই ছয় ছেলের মধ্যে মাত্র দুজন জমিদারি করে গেছেন। ইতিহাস বলছে, হায়দার আলীর ছেলেদের মধ্যে ইয়াকুব আলীর বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে খেলাফত ও কংগ্রেস কর্মী হিসেবে বড় ধরনের ভূমিকা ছিলো। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখানে স্কুল-মসজিদসহ একাধিক স্থাপনা নির্মাণ করেন।


হায়দার আলী ৪২ বছর বয়সে মারা যান। তিনি প্রায় ২০ বছর জমিদারী পেশা ধরে রেখে ছিলেন। তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এমদাদ আলী ও লুতফে আলী জমিদারী ধরে রাখেন।
এমদাত আলী ৭৪ বছর বয়সে এবং লুতফে আলী ৬০ বছর বয়সে মারা যান। বর্তমানে এই বাড়িটি এমদাত আলী ও আসমত আলীর নাতিদের দায়িত্বে থাকলেও সেখানে কেউ বসবাস করেন না।
১১৫৫ বঙ্গাব্দে হায়দার মহলের মূল ভবন নির্মাণ শেষ হয়। এই হায়দার মহলের মূল ভবন ছাড়াও পেছনের দিকে একতলা আরো চারটি ভবন রয়েছে।সবগুলো ভবন এখন জরাজীর্ণ হয়ে টিকে আছে। হায়দার মহলের মূল প্রবেশ পথ এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ভবনগুলো তৈরিতে ব্যয়বহুল চুনা ও সুরকি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিটি দেয়াল দেড় হাত পুরু। ভবন নির্মাণের সময় ভিম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নতমানের শাল কাঠ- যা এত বছর পর এখনো অক্ষত। বাড়িটির আয়তন সর্বমোট ১১৪ একর ২২ শতাংশ।
এই বাড়িতে একটি বিশাল আকৃতির দীঘি রয়েছে। দিঘীতে আছে ঘাটবাধানো শান, আর সেই দিঘীর পাশেই মসজিদ, পুরাতন মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে নতুন মসজিদ তৈরি করা হয়েছে যেটা খুবই ভয়াবহ ঘটনা। ঐতিহাসিক একটি স্থাপনা ভেঙ্গে সেখানে নতুন কোন স্থাপনা তৈরি এটা আসলে মানা যায় না। সে সময় এ বাড়ির জমিদাররা শখ করে হরিণ, ময়ূরসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রাণী পুষতেন। কালের সাক্ষী হিসেবে আজো ওই হায়দার মহলে বিশাল আকৃতির হরিণের শিং, ময়ূরের পালক, বাঘের চমড়াসহ নানা রকম ঐতিহ্য সংরক্ষিত আছে।
এছাড়াও কিছু কিছু ঐতিহ্য জাতীয় জাদুঘরে শোভা পেয়েছে। তৃতীয় তলায় দেখা যায়, কয়েকশ বছরের প্রাচীন এ ভবনের প্রতিটি দেয়াল পুরনো কিন্তু আজো অক্ষত। শুধু কয়েক স্থানে শ্যাওলা জমে আগাছার সৃষ্টি হয়েছে। হায়দার মহলের সামনের দিকে দক্ষিণ পাশে রয়েছে ফুলের বাগান, দরজায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, সুপ্রাচীন প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাইক্লোন শেল্টার, ঈদগাহ মাঠসহ বাড়ির ভেতরে অসংখ্য গাছ-গাছালি।
হায়দার মহল এখন নিরব।

No comments

Powered by Blogger.