Adsterra

স্বাধীনতার মহাকাব্য

 

স্বাধীনতার মহাকাব্য, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, Today Trending News

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ তারিখে পদ্মা-মেঘনা-যমুনাবিধৌত এতদঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি ’৪৮ থেকে শুরু করে ’৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে, আর দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে শামিল হয়ে ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়তে; তিনিই হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তত্কালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উদ্বেলিত মহাসমাবেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধুর সেই তেজোদীপ্ত উচ্চারণ—‘এবারের সংগ্রাম আমদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুধু স্বাধীনতাযুদ্ধে নয়, সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে।


বঙ্গবন্ধু বাংলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল, বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলা গড়ার। তিনি এক সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।


পকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিপিসি রিপোর্টবিরোধী আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, রাজবন্দিদের মুক্তি, খাদ্য আন্দোলন এবং পাকিস্তানিদের পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক শাসন, নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার প্রভৃতি তুলে ধরে আন্দোলন করে সাড়ে ১৩ বছর তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন এবং মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন। সবশেষ বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানের বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ হিসেবে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ দফা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী স্বয়ং ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান থেকে শুরু করে তত্কালীন তার মন্ত্রিসভার সদস্য জুলফিকার আলি ভুট্টো এবং পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনায়েম খানসহ এই ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া শুরু করে, স্বয়ং আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় মোকাবিলা করার হুমকি দেয়।


বঙ্গবন্ধু প্রেস কনফারেন্স করে ৬ দফার ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দেন এটা কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি নয়। বাঙালিদের বহু দিনের দাবি স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকার। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা প্রচারে ঝটিকা সফর শুরু করেন। বিভিন্ন জায়গায় এই জনসভা করার জন্য বিভিন্ন জেলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে পরবর্তী জনসভায় যেতেন। টানা ৩২ দিনে তিনি বাংলার মানুষের কাছে ৬ দফা পৌঁছে দেন এবং মানুষ বাংলার মুক্তি সনদ হিসেবে ৬ দফাকে গ্রহণ করেন।


৮ মে, ১৯৬৬ তাকে গ্রেফতার করা হয়। জেলে থাকা অবস্থায় দুই বছরের মাথায় ১৯৬৮ সালে তাকে ১ নম্বর আসামি করে তিন জন সিএসপি অফিসার, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীর কতিপয় অফিসারসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেয়। মামলা দিয়ে তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর ব্যবস্থা করা হয়। জনগণ রুদ্ররোষে আপন ইচ্ছায় রাজপথে নেমে আসে।


গঠিত হয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র-শ্রমিক জনগণ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সরকারের দেওয়া কারফিউ ভঙ্গ করে রাজপথ দখল করে। মামলার বিচারকরা পাকিস্তানে পলিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সরকার বঙ্গবন্ধুসহ ৩৪ জনকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন। তিনি নির্বাচন দেন। শত প্রতিকূলতা-ষড়যন্ত্র ভেদ করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের ৩০০ আসনের ১৬৭টি আসন লাভ করেন। প্রমাদ গুনলেন শাসকগোষ্ঠী, নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হলো; ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন ১ মার্চ বন্ধ করে দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ সমগ্র দেশ আন্দোলনে ফেটে পড়ল।


জনগণ রাজপথে পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো শুরু করল। স্লোগান উঠল :বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; তোমার নেতা-আমার নেতা-শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু পল্টনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ে বক্তব্য দিলেন এবং বললেন ৭ মার্চ তিনি মূল বক্তব্য দেবেন।


এলো সেই দিন মাহেন্দ্রক্ষণ ৭ মার্চ লাখো মানুষের ঢল নামে, সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। সেই দিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জেগে উঠেছিল পুরো জাতি। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের, যেদিন তিনি দেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। তাতে ছিল নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা। এটি ছিল একটি এপিক ভাষণ; এ ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করলেন তিনি। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে নিউজ উইক ম্যাগাজিন ওদের একটি কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে Poet of Politics বলে আখ্যায়িত করে। সাংবাদিক শেরিল ডান বলেছেন, ‘বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা ; যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে এবং জন্মে একজন পূর্ণাঙ্গ বাঙালি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অসীম। তার কণ্ঠ বজ্রকঠিন। তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বে সহজেই আবিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। তার সাহস এবং অনুপ্রেরণা শক্তি তাকে এ সময়ের অনন্য সেরা মানবে পরিণত করেছে।’ সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক করতে এ ভাষণের কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি যথার্থই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। রেসকোর্স ময়দানে-সেই দিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল।


বক্তৃতার শুরুতেই তিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন, অত্যাচার, বৈষম্য তুলে ধরেন। দ্বিতীয় অধ্যায় : ১ মার্চ থেকে আজ ৭ মার্চ পর্যন্ত বাংলার আন্দোলনরত মানুষের ওপরে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় তার বিবরণ দেন।


সবশেষ ছিল তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। নির্দেশনার প্রাথমিক অধ্যায় ছিল অসহযোগ আন্দোলনের। ট্যাক্স, খাজনা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা—সর্বাত্মক হরতালের ডাক। তার অসহযোগ আন্দালনে সাড়া দিয়ে হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস টিক্কা খানের শপথ পড়াননি।


তিনি জানতেন, হয় তাকে গ্রেফতার করা হবে অথবা মেরে ফেলা হবে। তাই আগাম বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দিবা।’ সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বললেন, ‘তোমাদের বলি, তোমরা ব্যারাকে থাকো—আর আমার ভাইয়ের ওপর গুলি চালানোর চেষ্টা করো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি—কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব—এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ—এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।

চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com 

No comments

Powered by Blogger.