নারী নেতৃত্ব মানতে সমস্যা কোথায় ?
শাহিনা খাতুন তার ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেছেন। ফিরে এসে তিনি জানিয়ে দিলেন এই পরিবারে ছেলের বিয়ে দেবেন না। মেয়ে শিক্ষিত, পরিবারও ভালো। কিন্তু তারপরেও তিনি এই বিয়েতে রাজি না। কারণ হিসেবে জানালেন মেয়ের মা ‘মুখে মুখে’ কথা বলে। কোনও প্রশ্ন করলে মেয়ের বাবার আগে মেয়ের মা উত্তর দেয়। যে পরিবারে ছেলেরা থাকতেও মেয়েরা ‘মাতবর’ হয়, সে পরিবারের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক করতে রাজি না। এই পরিবারের মেয়ে ঘরে আনলে সেও ‘ছড়ি’ ঘোরাবে মায়ের মতো।
শাহিনা খাতুনের ঘটনার মতোই একটি ভাইরাল বাণী প্রায়ই ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের হোমপেইজে। বাণীটি হচ্ছে, ‘যে সংসারে পুরুষ থাকতেও নারীরা মাতবর, সে সংসারে সম্পর্ক করাটা অনুচিত।’ কেবল ছেলেরা নয়, মেয়েরাও এমন একটি আপত্তিকর কথা শেয়ার দিচ্ছে হরদমই। অর্থাৎ একটি সংসারে মেয়েরা প্রধান হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে- এমন ধারণা খোদ মেয়েরাই মানতে পারছে না। পরিবার থেকেই যদি ছোট করে দেখা হয় নারীর নেতৃত্বকে, তবে কর্মক্ষেত্রে বা সমাজের বিভিন্ন স্তরে কীভাবে তৈরি হবে নারী নেতৃত্ব?
আবার নানা বাধা পেরিয়ে যেসব নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারাও কিন্তু পদে পদে সম্মুখীন হচ্ছেন নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার।
ক্যাথওয়েল্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মানব সম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন কাজী তাসনুভা তারান্নুম। কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মেয়ে হওয়াই বড় প্রতিবন্ধকতা। শুরুর দিকে বস হিসেবে কেউই মানতে চাইতো না। আমি কোথাও নেতৃত্ব দিচ্ছি এটা মেনে নেওয়া বাকিদের জন্য কষ্টকর ছিল। এখনও যখন আমি পুরুষ সহকর্মীদের ভুল ধরি, তাদের ইগোতে লাগে। আমি পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি, এটা নিয়েও বাকিদের সমস্যা। আমি পরিপাটি থাকি বলেই নাকি আমার সব কাজ খুব সহজে হয়ে যায়- এমন একটি কথা প্রচলিত আছে অফিসে। অর্থাৎ আমার কোনও প্রতিভা নেই। আমি কেবল সেজেগুজে থাকি বলেই সব কাজ ঠিক মতো হয়। এছাড়া মেয়েদের কাজের জায়গায় নিরাপত্তাজনিত ইস্যুও আছে।’
একটি বেসরকারি ব্যাংকের সহযোগী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন নূপুর। কর্মক্ষেত্রের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি কথা বললেন। নূপুর বলেন, ‘পদোন্নতি পেয়ে বড় একটি পদে আমার যাওয়াটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। তার উপর আমি সিঙ্গেল মাদার। এমন না যে আমাকে কথা দিয়ে আঘাত করবে। দৃষ্টি দিয়েও আরেকজনকে ছোট করা যায় সেটা আমি পদোন্নতি পাওয়ার পর বুঝলাম। ধরুন একটা মিটিংয়ের জন্য রুমে ঢুকেছি। অনেক চোখের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাঙ্গাত্নক দৃষ্টিতে তাকাবে। সেই দৃষ্টি বলছে আমি কিছু না করেই এই পদে চলে এসেছি। আমার কোনও প্রতিভাই নেই। অথচ বছরের পর বছর এখানে পরিশ্রম করে আমি আজকে এই জায়গায় এসেছি। মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগে। তবে এদেরকে সাথে নিয়েই আমার চলতে হবে, এটা মেনে নিয়েছি।’
শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প। সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, ‘নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে না পারাটা আসলে পুরুষের অক্ষমতা। কেউ যদি মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ না করে কিংবা নিজেকে অন্য জীব হিসেবে মনে করে- তবে এটা তার ব্যর্থতা। যে নারী এই বিষয়টাকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে এবং মেনে নেয়, সেও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার অধিকারী।’
কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানে নানা প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। পরিবারের ক্ষেত্রে এটা যেন আরও প্রখর। পরিবারে ছেলেরা থাকতেও মেয়েরা নেতৃত্ব দেবে এটা এখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি সেভাবে। ছেলেদের উপার্জন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশি এটা কি একটা কারণ এক্ষেত্রে? এমন প্রশ্নের জবাবে খুশি কবির বলেন, ‘এমনটা মোটেই নয়। অনেক উচ্চ শিক্ষিত বেশি উপার্জন করা নারীও অনেক সময় সংসারে তার প্রাপ্য সম্মান পায় না। সমস্যাটা আমাদের মানসিকতায়। আমাদের সমাজ অনুযায়ী নারীদের মূল কাজ হচ্ছে সেবাপ্রদান। সংসার সামলানো, সন্তানদের দেখাশোনা করা বা রান্না করা। এর বাইরে উপার্জন করলে সেটা বাড়তি। অথচ যদি আমরা নারীর ঘরের কাজে অর্থনৈতিক অবস্থান দেখি, তখন আসলে বুঝবো অর্থনৈতিকভাবে কার উপার্জন কতটুকু। অন্যদিকে পুরুষের কাজ হচ্ছে উপার্জন করা। সংসারে যদি পুরুষের চেয়ে নারী বেশি উপার্জন করে, তাহলেও যে নারীর নেতৃত্ব সেখানে প্রতিষ্ঠা পাবে এমন নয়। বরং পুরুষের কম উপার্জনের বিষয়টি নানাভাবে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা হবে। যেমন কোনও কারণে সে কাজ পায়নি কিংবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার উপার্জন কম। কিন্তু নারী যে তার প্রতিভা অনুযায়ী একটা ভালো পদে কাজ করছে, সেই প্রশংসাটুকু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই করা হবে না।’
একজন মেয়েকে পরিবার থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলি শিক্ষা দিতে হবে উল্লেখ করে খুশি কবির বলেন, ‘আত্নবিশ্বাসের অভাবে স্বাবলম্বী নারীরাও দিনের পর দিন তাদের উপর করা অত্যাচার সহ্য করে যান। কারণ পরিবার থেকেই তাদের শেখানো হয় মুখ বুঝে সহ্য করা বা মানিয়ে চলার বিষয়টা। আবার অনেক নারী চাইলেও ছেড়ে আসতে পারেন না কারণ তাদের সাপোর্ট সিস্টেম নেই। তবে আমি বলবো এই ধরনের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। চেষ্টা করলে মানসিকতার পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব।’
No comments