সম্রাট আকবরের সময় থেকে বর্ষবরণ শুরু হয়
অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি আর সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় বর্তমানে যেভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়, ইতিহাসবিদরা বলছেন, সবসময়ই এই রূপে বর্ষবরণ করা হতো না। বরং কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতায় নানা পরিবর্তন এসেছে।
তারা বলছেন, মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা সন গণনা শুরু হওয়ার পর খাজনা আদায়ের পর যে উৎসব থেকে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল তা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
এই ধারাবাহিকতায় কখনো আগের বিভিন্ন নিয়ম বাদ দেয়া হয়েছে, আবার কখনো নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এই উৎসবের সাথে। ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতি আর রাজনীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে এই উৎসব।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, বিভিন্ন সময়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হয়েও উঠেছে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আইয়ুব খানের আমল এবং আশির দশকের শেষের দিকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ছিল বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা।
প্রশ্ন আসে যে, নববর্ষের উদযাপন আসলে কখন শুরু হয়েছিল আর এটি কিভাবেই বা পরিবর্তিত হয়েছে। যেভাবে শুরু। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মোটামুটি একমত যে, ১৫৫৬ সালে মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের শাসনামল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছিল।
যদিও বাংলা সন শুরু হয়েছিল আরো পরে, কিন্তু এটি সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকেই কার্যকর বলে ধরা হয়। তবে শুরুতে এটি বর্ষবরণ ছিল না। বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা পরে যোগ করা হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, সম্রাট আকবর তার রাজত্বে খাজনা তোলার প্রক্রিয়া সহজ করতে ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ই মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। নতুন সনটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘ফসলি সন’ পরে যা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি পায়।
শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প। সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান ২০২২ সালে তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, বাংলা সন প্রবর্তনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি সৌর সন ও আরবী হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে বাংলা সন ও তারিখ নির্ধারণ করেন। আর এই ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার নাম দেয়া হয় তারিখ-ই-এলাহী। এই পুরো কাজটি করা হয়েছিল ফসল উৎপাদনের ঋতুচক্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যাতে ফসল উঠার সময়টাতেই খাজনা আদায় করা যায়।
এর ধারাবাহিকতায় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করতো। এর পরের দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষ্যে তখন মেলা বসতো। আয়োজন করা হতো আরো নানা অনুষ্ঠানের।
মি. রহমান তার লেখায় বলেন, সম্রাট আকবরের অনুকরণে সুবেদার ইসলাম চিশতি তার বাসভবনের সামনে প্রজাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ ও বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। এই উপলক্ষ্যে খাজনা আদায় ও হিসাব নিকাশের পাশাপাশি মেলায় গান-বাজনা, গরু-মোষের লড়াই, কাবাডি খেলা হতো।]
বাংলাপিডিয়া বলছে, আগে নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোটাই অর্থনৈতিক এবং গ্রামে-গঞ্জে ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের শুরুর দিনে তাদের পুরনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষ্যে তারা তাদের নতুন-পুরনো খদ্দেরদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি মুখ করাতেন। এই আমন্ত্রণ গ্রহন করতে এসে অনেক খদ্দের তাদের পুরনো দেনার পুরোটা বা কিছু অংশ শোধ করে নতুন খাতায় হিসাব হালনাগাদ করতেন।
অতীতের তুলনায় এই আনুষ্ঠানিকতা বেশ কমে গেছে। তবে এখনো কোথাও কোথাও পহেলা বৈশাখে হালখাতার চল চোখে পড়ে।
চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির সাথে জড়িত একটি বিষয় ছিল বিদায় বা বর্ষ বিদায়। আর এর জন্য প্রতিমাসের শেষে একটি সংক্রান্তি পালন করার রীতিও বহু বছর আগে থেকেই চালু ছিল।
বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়েছিল নক্ষত্র অনুযায়ী। নববর্ষে চৈত্র মাস বা চিত্রা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ বা বিশাখা নক্ষত্রে গমন বা সংক্রমণই হচ্ছে চৈত্র সংক্রান্তি। প্রতি মাসেই এই সংক্রমণ ঘটে। যেমন বাঙালি সংস্কৃতিতে পৌষ সংক্রান্তি এখনো উদযাপন করা হয়।
কিন্তু প্রতি মাসে সব সংক্রান্তি পালন করাটা বাঙালিদের জন্য ঝামেলার হয়ে যায় অর্থনৈতিক কারণে। যেমন কার্তিক মাসে কার্তিক সংক্রান্তি পালন করা হতো না কারণ ওই সময় অভাব থাকতো। সবচেয়ে বেশি চৈত্র সংক্রান্তি পালন করা হয়েছে যেহেতু এ সময় পুরো একটি বছর শেষ হয়ে গিয়ে নতুন একটি বছর আসে, তাই।
এই চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপনের রীতি বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হওয়ার অব্যাবহিত পর থেকেই শুরু হয় বলে জানান মি. শেখর।
তিনি বলেন, এই চৈত্র সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে যে মেলা হতো, এবং তাতে জনগণের যে অংশগ্রহণ হতো তা চৈত্র মাসের শেষ দিন ছাপিয়ে পরের বৈশাখ মাস বা পরের বছরের প্রথম দিনগুলোতেও থাকতো।
চৈত্র সংক্রান্তির এই মেলাকে মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা বলা হতো। স্থানীয় কৃষিজাত পণ্য, কারুপণ্য, হস্ত ও মৃত শিল্প, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, লোকজ খাবার যেমন চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন রকমের মিষ্টি ছিল এসব মেলার মূল আকর্ষণ।
এছাড়া বিনোদনের অংশ হিসেবে থাকতো যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান ইত্যাদি।
তবে সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মেলারও পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে শহর বা গ্রামাঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির মেলার পাশাপাশি বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা মুঘল আমলে সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে শুরু হয়েছে বলেই ধারণা প্রচলিত আছে।
“মুসলিম শাসনের ৫০০ বছর থেকেই এটি শুরু হয়েছে। এরপরের ইংরেজ আমলের পৌনে দুইশ বছরে সংক্রান্তি থেকে নববর্ষের দিকে উদযাপিত হয়েছে, তারপরে পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে এটি সাংস্কৃতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং সেখানে ম্লান হয়ে গেছে চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখই উদযাপনটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে।”
No comments