স্মরণে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীর অন্দরের অজানা কথা
‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল আড়াই বছর ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে রোজ যে শুটিং হয়েছে, তা নয়। তখনো সত্যজিৎ রায় বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অধিকাংশ শুটিং হতো ছুটির দিনে বা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। এর সঙ্গে ছিল অর্থাভাব। সত্যজিৎ তাঁর জীবনবিমার টাকা, নিজের আর্টবুক বিক্রি করে কিছু, আর নিকটতম বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে সিনেমার শুটিং শুরু করেন। অর্থাভাবে প্রায়ই কাজ বন্ধ থাকত। টাকা জোগাড় হলে তবেই আবার হতো শুটিং।
মিলছে না অপুর খোঁজ
তত দিনে সত্যজিৎ রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তিনি সিনেমা বানাবেন। বিলেত থেকে ফেরার পথে জাহাজে বসেই লিখে ফেলেছেন ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্য। এবার আসল কাজ, মানে শুটিংয়ে নামার পালা। ছুটির দিনে শিল্প নির্দেশক বংশীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন লোকেশনের খোঁজে। তা ছাড়া সত্যজিতের বেড়ে ওঠার সঙ্গে তো গ্রামের যোগাযোগ অতটা ছিল না। গ্রামীণ প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবনযাপন অনেকটাই তাঁর জানার বাইরে ছিল। ফলে গ্রামকে আবিষ্কারের নেশায় তখন বুঁদ সত্যজিৎ। ভেতরে-ভেতরে একটা যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক যুক্ত হচ্ছেন টিমে। কিন্তু প্রধান দুই চরিত্র অপু আর দুর্গা কারা হবে, তা ঠিক হয়নি তখনো। খোঁজ চলছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে। শত শত শিশুর ইন্টারভিউ করা হয়েছে। কিন্তু কাউকে মনে ধরছে না সত্যজিতের।
হঠাৎ নজর গেল একটি ছেলের দিকে
এক বিকেলে বাড়ির জানালায় হঠাৎ শিশুদের কলরব। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া শাশুড়ির সঙ্গে গল্প করছিলেন। শিশুদের হইচই শুনে নিচে তাকালেন। কয়েকটি শিশু খেলা করছে। হঠাৎ তাঁর নজর গেল একটি ছেলের দিকে। ভারী সুন্দর ফুটফুটে চেহারা, বছর পাঁচ–ছয় হবে। ছেলেটিকে দেখে বিজয়ার মনে হয়, ‘আহা, এ রকম দেখতে ছেলের মতো যদি আমাদের অপুকে পাওয়া যেত!’ তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, ছেলেটি অবাঙালি। কারণ তাঁদের পাড়ায় তখন বেশির ভাগই দক্ষিণ ভারত আর উত্তর প্রদেশের লোক থাকত। তবুও বাড়ির কাজের মহিলাকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন ছেলেটিকে। কথা বলে বুঝলেন, ছেলেটি বাঙালি।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে সত্যজিৎ ফিরতেই সুখবর শোনালেন বিজয়া, ‘অপুকে পাওয়া গেছে।’ শুনে সত্যজিৎ তো অবাক! এত বিজ্ঞাপন দিয়ে যাকে পাওয়া গেল না, শেষে তার খোঁজ মিলল পাশের বাড়িতে! আবারও ছেলেটিকে ডেকে পাঠানো হলো। সুবীর ব্যানার্জিকে (ছেলেটির নাম) দেখে তৃপ্তির হাসি হাসলেন সত্যজিৎ। এর চেয়ে ভালো অপু আর কেউ হতে পারে না! এরপর দুর্গাকে পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না। সত্যজিতের সহকারী আশিস বর্মণের মাধ্যমে পাওয়া গেল উমা দাশগুপ্তকে। সে–ই পথের পাঁচালীর দুর্গা।
শুরুতেই গোলমাল
প্রথম দিনের শুটিং। অপু–দুর্গাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কলকাতা থেকে ৭০ মাইল দূরে বর্ধমানের কাছে পালসিট বলে একটা জায়গায়। সেখানে রেললাইনের ধারে কাশফুলে ভরা মাঠ। অপু–দুর্গার সেই বিখ্যাত কাশবনের ভেতরে ঘোরার দৃশ্য তোলা হবে। বেশ বড় দৃশ্য। তাই একদিনে হবে না, অন্তত দুই দিন লাগবে। সকাল থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত অর্ধেক দৃশ্য তোলা হলো। প্রথম দিন শুটিংয়ের এক সপ্তাহ পর আবার একই জায়গায় শুটিং। কিন্তু লোকেশনে গিয়ে সবাই অবাক! সেই কাশবন আর নেই! স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কাশফুল নাকি গরুর খাদ্য! এই এক সপ্তাহে সব কাশ খেয়ে গেছে ওরা। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে সেখানে শুটিং করলে আর প্রথম দিনের শুটিংয়ের সঙ্গে মিলবে না। এ দৃশ্যের বাকি অংশ তাই তোলা হয় পরের বছরের শরৎকালে। তখন আবার নতুন কাশে মাঠ ভরে গেছে।
শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প। সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন
সাদা কাশ, কালো ধোঁয়া
এ শিডিউলে সেই বিখ্যাত ট্রেনের শটও নেওয়া হয়। ট্রেনের এত শট ছিল যে, একটা ট্রেনে কাজ হয়নি। পরপর তিনটি ট্রেন ব্যবহার করা হয়। কাছাকাছি স্টেশনে থাকতেন পথের পাঁচালী টিমের অনিল বাবু। ট্রেন এলে তিনি ড্রাইভারের পাশে বসে পড়তেন। কারণ ট্রেন শুটিং স্পটের কাছাকাছি এলেই বয়লারে কয়লা দিতে হবে। তা না হলে কালো ধোঁয়া বেরোবে না। সাদা কাশফুলের পাশে কালো ধোঁয়া না পেলে দৃশ্য জমবে কীভাবে!
একটি কুকুরের মৃত্যু
অপু–দুর্গার পোষা কুকুর ভুলো পথের পাঁচালী সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। গ্রাম থেকে একটি কুকুর জোগাড় করা হয়েছিল। সে বেশ মিশে গিয়েছিল সিনেমার ইউনিটের সঙ্গে। এক দৃশ্যে মা সর্বজয়া অপুকে ভাত খাওয়াচ্ছে। ভুলো দাওয়ায় বসে তা দেখছে। খাওয়ায় বিশেষ মন নেই অপুর। সে ব্যস্ত তীর–ধনুক নিয়ে। মা বুঝতে পারে, অপু আর খাবে না। পরের শটে দেখানো হবে সর্বজয়া বাকি ভাতটুকু আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেন। আর পোষা কুকুরটি গিয়ে সেই ভাত খেয়ে নেয়। কিন্তু এ শটটা সেদিন নেওয়া গেল না। দিনের আলো ফুরিয়ে গেল। সঙ্গে টাকাও। মাস ছয়েক পরে টাকা জোগাড় হলে আবার বোড়াল গ্রামে শুটিং করতে যান সত্যজিৎ। কিন্তু জানা গেল, এ ছয় মাসের মধ্যে কুকুরটি মারা গেছে! এখন কী হবে! খবর পাওয়া গেল, ভুলোর মতো দেখতে আরেকটি কুকুর আছে গ্রামে। পরে তাকে নিয়ে এসে দৃশ্যটি সম্পূর্ণ করা হয়।
ফাঁকি ধরতে পারেনি কেউ
চিনিবাস ময়রার কাছ থেকে মিষ্টি কেনার সামর্থ্য দুর্গা–অপুর নেই। তাই ময়রার পেছন ধাওয়া করে তারা যায় মুখুজ্যেদের বাড়ি। তারা বড়লোক, মিষ্টি কিনবেই, আর তা দেখেই অপু–দুর্গার আনন্দ। এ দৃশ্য খানিকটা তোলার পর অর্থাভাবে শুটিং কয়েক মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। পরেরবার শুটিং করতে গিয়ে জানা গেল, চিনিবাসের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন, তিনি আর বেঁচে নেই। বিপদে পড়লেন সত্যজিৎ। এখন কী উপায়! চিনিবাসের মতো দেখতে নাদুসনুদুস আরেকজনকে নিয়ে এসে শট নেওয়া হলো। সিনেমায় দেখা যায়, এক নম্বর চিনিবাস বাঁশবন থেকে বেরোলেন, আর পরের শটেই দু’নম্বর চিনিবাস ক্যামেরার দিকে পিঠ করে মুখুজ্যুদের বাড়ির ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ‘একেই বলে শুটিং’ বইয়ে এ ঘটনার উল্লেখ করে সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘পথের পাঁচালী ছবি অনেকে একাধিকবার দেখেছে। কিন্তু কেউ কোনো দিন আমাদের ফাঁকি ধরতে পেরেছে বলে শুনিনি।’
একটি বাস্তুসাপ
পথের পাঁচালী সিনেমায় যে বাড়িটিকে অপু–দুর্গাদের বাড়ি হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেটি সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন জীর্ণ জংলা অবস্থায়। সেটিকে কাজের উপযোগী করে নিতে তাঁদের সময় লেগেছিল প্রায় এক মাস। বাড়ির এক অংশে সার বাঁধা পাশাপাশি কয়েকটা ঘর ছিল, সেটা সিনেমায় দেখা যায়নি। ঘরগুলোতে শুটিংয়ের মালপত্র রাখা হতো। আর সাউন্ডের যন্ত্র নিয়ে এক ঘরে বসতেন ভূপেন বাবু। সত্যজিৎ রায় প্রতি শটের পর হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘সাউন্ড ঠিক আছে তো?’ ভেতর থেকে জবাব দিতেন ভূপেন বাবু। একদিন শটের পর যথারীতি প্রশ্ন করলেন সত্যজিৎ। কোনো জবাব এল না। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থবারেও কোনো জবাব নেই। ঘরে ঢুকে সত্যজিৎ দেখলেন, একটি বিরাট গোখরো সাপ ঘরের পেছন দিকের জানালা দিয়ে ঢুকে মেঝেতে নামছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে ভূপেন বাবুর! এরপর সাপের ভয় নিয়েই পুরো শুটিং করতে হয়েছে তাঁদের। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সাপটিকে তারা মারতে পারেননি গ্রামবাসীদের নিষেধের কারণে। এটি নাকি বাস্তুসাপ। বহুদিন থেকে এই পোড়ো বাড়িতে বসবাস করছে!
No comments