গাজায় যুদ্ধের মাঝেও যেভাবে হচ্ছে প্রেম ও বিয়ে
প্রায় ২০০ দিন ধরে সংঘাত চলছে গাজায়। ইসরায়েলি বাহিনীর বিরামহীন বোমাবর্ষণ ও গোলার আঘাতে মাটিতে মিশে গেছে গাজার বেশির ভাগ বাড়ি-ঘর। উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করছেন শহরের প্রায় সব মানুষ। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ বিয়ের কথা ভাবছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতিই আবার কোনো কোনো যুগলকে এক করে দিয়েছে।
আজ মঙ্গলবার দ্য ন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বিধ্বস্ত গাজায় একাধিক যুগলের পরিচয় ও বিয়ের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলা হয়েছে ইমাদ হালাওবা নামে এক যুবকের কথা। যুদ্ধের আগে থেকেই তিনি বিয়ের জন্য পাত্রীর খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত আরও অনেক গাজাবাসীর মতো তিনি যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই বিয়ের কাজটি সেরে ফেলতে চাইছেন।
দ্য ন্যাশনালকে ইমাদ বলেন, ‘যুদ্ধের আগে বিয়ের জন্য আমি একটি উপযুক্ত পাত্রী খুঁজছিলাম। আমার মা বেশ কয়েকটি পাত্রীও দেখেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের আগে বিয়ে করা আমার ভাগ্যে ছিল না।’
গত বছরের অক্টোবরে যুদ্ধ যখন ছড়িয়ে পড়ে সেই সময়টিতে একজন ইলেকট্রনিক প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছিলেন ইমাদ। এই যুদ্ধে ইতিমধ্যেই পরিবারের ৬ সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি। এর ফলে বিয়ের ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল তাঁর। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায় যখন মোনা আল আনসারির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যায়। এই জুটি এবার শিগগিরই বিয়ে করতে যাচ্ছেন।
দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, চলমান সংঘাতের মধ্যে গাজার লোকসংখ্যার ৮৫ শতাংশেরও বেশি প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মূলত এমন পরিস্থিতিই এক করে দিয়েছে ইমাদ এবং মোনাকে।
ঘর-বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিলেন ইমাদের মায়ের বান্ধবী। পরে গাজার বেই লাহিয়ায় অবস্থিত ইমাদদের বাড়িতে নিজের ২৩ বছর বয়সী কন্যা মোনাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। ঠিক তখনই ইমাদের নজর কেড়েছিলেন মোনা।
ইমাদ বলেন, ‘আমি মোনাকে দেখলাম এবং তার আবেদন দেখে আমার মনে হয়েছিল সে আমার জন্য উপযুক্ত সঙ্গী হতে পারে।’
এরপর যখন মায়ের কাছে ইমাদ নিজের পছন্দের কথা জানালেন—তাঁর মা অবাকই হয়েছিলেন। মোনাকে প্রস্তাব পাঠানোর অনুমতি চেয়েছিলেন তিনি মায়ের কাছে। ইমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন মোনাও। পরে বিয়ের জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও বিয়ের বাগদান অনুষ্ঠানে তাঁরা আত্মীয়-স্বজনদের জড়ো করেছিলেন। যদিও সেই অনুষ্ঠানে কোনো গান হয়নি, বাদ্য বাজেনি।
মোনা আর ইমাদ আশা করছেন, চার মাস পর বড় করে তাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন। এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধ থেমে যাবে বলেও বিশ্বাস তাঁদের।
এদিকে যুদ্ধের আগে নিজের জীবন নিয়ে আকাশ-সমান প্রত্যাশা ছিল ২০ বছর বয়সী শিরীন আল কাফারনার। স্বপ্ন ছিল—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু যুদ্ধ সবকিছু বদলে দিয়েছে। বেইত হানুনে অবস্থিত তাঁর বাড়িটি বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় উদ্বাস্তু হয়ে শিরীনকে আশ্রয় নিতে হয় একটি স্কুলে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার অধীনে সেখানে একটি আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছিল।
সেই আশ্রয় শিবিরেই অপ্রত্যাশিতভাবে একটি বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছেন শিরীন। যিনি প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন তিনিও উদ্বাস্তু হয়ে একই স্কুলে অবস্থান করছিলেন।
দ্য ন্যাশনালকে শিরীন বলেন, ‘শুরুতে আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কারণ এই পরিস্থিতির মধ্যে বিয়ে করার কথা আমি চিন্তাও করতে পারছিলাম না।’
তবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পর শেষ পর্যন্ত মোহম্মদ কাসিমের ওই বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন শিরীন। ২৬ বছর বয়সী কাসিম বেইত হানুনের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে তিনি ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
পরিবারের কয়েক সদস্যকে হারানো শিরীন বর্তমানে সুখী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাঁর বাগদান অনুষ্ঠান হয়েছিল একটি ক্লাসরুমের ভেতর। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন বলেও আশা করছেন। মোহম্মদ কাসিম তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শিরীন বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত আমার জন্য যদি ভালো কিছু করে থাকে তবে তা হলো—মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া।’
No comments