বিশ্ব বই দিবস : হতে পারে সোনালি প্রজন্ম গড়ার প্রেরণা দিন
যদি এখন থেকেই একটি সামগ্রিক জোরালো উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে ২০২৭ সালে বিশ্ব বই দিবসে ঢাকা ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটালের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলে দেশ ও জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বদরবারে সম্মানিত হব।
২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস। এ বছর ১০০টির অধিক দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বই দিবস। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর দেশগুলোয় বিশ্ব বই দিবসের আয়োজন রীতিমতো বিস্ময়কর। আমরা জানি, আগামী পৃথিবীর নেতৃত্ব দেবে মেধাবীরা আর সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামো হয়ে উঠবে জ্ঞানভিত্তিক। বিশ্বায়নের এই যুগে মেধাবী প্রজন্ম এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার মূল উপাদান হচ্ছে বই এবং চর্চার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে পাঠাভ্যাস। বিশ্ব বই দিবস বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব বই দিবসটির সূচনা কীভাবে হয়েছে ?
কথিত আছে, স্পেনের কাতালানে জন্ম নেওয়া বীর রোমান যোদ্ধা সেন্ট জর্ডি তাঁর তরবারির আঘাতে ড্রাগন বধ করে বাঁচিয়েছিলেন কাতালানের রাজকন্যাকে। নিহত ড্রাগনের রক্তে ভেজা সেই মাটিতে বেড়ে ওঠে একটি গোলাপ। একদিন বীর জর্ডি সেই গোলাপগাছের একটি গোলাপ উপহার দেন রাজকন্যাকে। বিনিময়ে রাজকন্যা দিয়েছিলেন প্রেম এবং জ্ঞান। ২৩ এপ্রিল ৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা কর্তৃক বীর জর্ডির হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড কাতালানবাসীকে শোকে মুহ্যমান করে তোলে, আরও বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন জর্ডি। জর্ডির সম্মানে সেই থেকে কাতালানবাসী অনানুষ্ঠানিকভাবে ২৩ এপ্রিল উদ্যাপন শুরু করে জর্ডি দিবস। অবশেষে ১৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কাতালান পার্লামেন্টে ২৩ এপ্রিলকে সেন্ট জর্ডি স্মরণে ‘ফেস্টিভ্যাল ডে’ ঘোষণা করা হয়। এই ফেস্টিভ্যাল ডেতে প্রিয়জনকে গোলাপ ফুল এবং বই উপহার দেওয়ার প্রচলন শুরু করা হয়। জর্ডি ডেতে পুরো কাতালানের গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সব স্থানে বই আর ফুলের বিপুল পসরা বসত। এই উৎসব ক্রমেই পুরো স্পেনে ছড়িয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করে।
স্পেনের লেখক ভিসেন্তে ক্লেভেল আন্দ্রেসের মাথায় প্রথম বিশ্ব বই দিবস পালনের আইডিয়ার উদ্ভব ঘটে। ভিসেন্তে ছিলেন স্পেনের বিখ্যাত লেখক মিগুয়েল সার্ভেন্তেসের ভাবশিষ্য। তাই মিগুয়েল সার্ভেন্তেসের সম্মানে তাঁর জন্মদিন ৭ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস ঘোষণা করে ১৯২৬ সাল থেকে ভিসেন্তে বিশ্ব বই দিবস পালনের সূত্রপাত করেন। এটি কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ১৯৩০ সালে স্পেনের রাজা আলফোনসো-১৩ জর্ডি দিবসের সঙ্গে সমন্বয় করে ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস নির্ধারণ করেন। সেই থেকে স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হতে শুরু করে।
১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকো তাদের সম্মেলনে মানুষকে বই পড়ায়, লেখায় এবং প্রকাশনায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে একটি বিশেষ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ইউনেসকো ১৯৩০ সাল থেকে ২৩ এপ্রিল স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বিশ্ব বই দিবস, পৃথিবীর বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এবং ইনকা গারসিলাসো দে লা ভেগার মৃত্যু দিবসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২৩ এপ্রিলকেই ‘বিশ্ব বই দিবস এবং কপিরাইট দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।
বিশ্ব বই দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর ইউনেসকো একটি থিম ঘোষণা করে। ২০২৪ সালে বিশ্ব বই দিবসের থিম হচ্ছে, ‘রিড ইওর ওয়ে’। ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছর একটি শহরকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ‘ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল’ ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালে প্রথম ‘ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল’ হিসেবে জয়ের মুকুট ছিনিয়ে নেয় মেক্সিকোর গুয়াদালাজারা শহর। ২০২৪ সালে এ বিজয় অর্জন করে ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ শহর। ২০২৫-এর বিজয়ী ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহর। ২০২৬-এর প্রতিযোগিতার জন্য আবেদনপত্রসহ যাবতীয় প্রামাণ্য কাগজপত্র গ্রহণের সর্বশেষ তারিখ ছিল ১০ এপ্রিল ২০২৪। ফলাফল এখনো অপ্রকাশিত।
আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণের শহর ঢাকাও এই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে ২০২৭ সালের জন্য। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের শিক্ষা বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক উদ্যোগ, লেখক-প্রকাশকের যৌথ প্রয়াস এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সর্বাত্মক সহযোগিতা। যদি এখন থেকেই একটি সামগ্রিক জোরালো উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে ২০২৭ সালে বিশ্ব বই দিবসে ঢাকা ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটালের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলে দেশ ও জাতি হিসেবে আমরা যেমন বিশ্ব দরবারে সম্মানিত হব, তেমনি এই উদ্যোগের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করার পথে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব।
আমেরিকা, ইউকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ, চীন, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারতসহ শতাধিক দেশে বিশ্ব বই দিবসে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক সমন্বয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী বেশ চমৎকার কিছু কর্মসূচি পালিত হচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণভাবে, যা বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। উল্লেখযোগ্য কিছু কর্মসূচি হচ্ছে:
১. প্রিয় গল্প-উপন্যাস বইয়ের সবচেয়ে প্রিয় চরিত্রে নিজেকে পোশাকে-মেকআপে সাজিয়ে বিশ্ব বই দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজিত সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ।
২. বিশ্ব বই দিবসে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার পাঠকৃত প্রিয় বই নিয়ে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকবে। শ্রেণিশিক্ষকের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা যার যার পছন্দের বই বিনিময় করবে। পাঠ করা বইয়ের বিষয় নিয়ে পাঠচক্রের আয়োজন।
৩. শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে তাঁদের কল্পনার জগৎ কেন্দ্র করে গল্প বলতে উৎসাহিত করবেন, প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করবেন।
৪. পাঠ করা প্রিয় বইয়ের রিভিউ লেখার প্রতিযোগিতা।
৫. অভিভাবকদের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীর নিজ জীবনে ঘটে যাওয়া যেকোনো বিষয়ের ওপর গল্প লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন।
৬. বিশ্ব বই দিবসে বইপড়াকে উৎসাহিত ও অনেক বই থেকে নিজের পছন্দের বই বেছে নিতে বিচিত্র রকম সমৃদ্ধ বইয়ের সমন্বয়ে ক্লাসে ক্লাসে দর্শনীয় বুক কর্নার স্থাপন।
৭. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের লেখকদের আমন্ত্রণ জানানো। লেখকেরা ক্লাসে ক্লাসে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অডিটোরিয়ামে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হবেন, তাঁদের সৃষ্ট বিভিন্ন চরিত্রের বা লেখার বিভিন্ন বিষয়ের পেছনের মজার মজার গল্প বলবেন। এতে শিক্ষার্থীরা সেই গল্প-সংশ্লিষ্ট বইগুলো পড়তে উৎসাহিত হবে, যা তাদের সৃজনশীল মননজগৎ নির্মাণে ভূমিকা রাখবে। অনেক সময় লেখক সরাসরি উপস্থিত হতে না পারলে জুম বা স্কাইপের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেও এ রকম কর্মসূচি করা হয়।
৮. নির্দিষ্ট সময়ে কে কত বেশি বই কতটা কোয়ালিটিপূর্ণভাবে পাঠ করতে পারল, সেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
৯. ফুলস্কেপ কাগজের সিটে বইয়ের তালিকার সঙ্গে ছোট করে ঘটনার ক্লু বা চরিত্র উল্লেখ করে অথবা লেখকের তালিকা দিয়ে মিলকরণ প্রতিযোগিতার আয়োজন।
১০. বুক ক্লাব অথবা পাঠাগারগুলোতে বিশ্ব বই দিবসে বই নিয়ে আলোচনা, মুক্ত মতামত প্রদান, গ্রুপ স্টাডির আয়োজন।
১১. দেশব্যাপী বইবিষয়ক সভা, সেমিনার আয়োজন।
১২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই-বন্ধু কর্মসূচি বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে বন্ধুত্বে বয়স বিবেচ্য হবে না; বরং কে কত ভালো পাঠক, সেই বিবেচনায় জোড়ায় জোড়ায় বন্ধু গ্রুপ ঠিক করে দেবেন শিক্ষক। তারা অন্তরঙ্গতার সঙ্গে বইপাঠ, আলোচনা এবং নিজস্ব ভাবনাবিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করবে।
এ রকম বহুমুখী সৃজনশীল কর্মসূচি বিশ্ব বই দিবসকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের সোনালি প্রজন্ম গড়ার প্রত্যয়ে পালিত হচ্ছে। সৃজনশীল জ্ঞানভিত্তিক জাতি নির্মাণে বাংলাদেশেও বর্ণাঢ্য আয়োজনে বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব বই দিবস পালন এখন সময়ের দাবি। আবার শুধু বিশ্ব বই দিবসে এক দিনের জন্য সব আয়োজন করে থেমে গেলে চলবে না। এই সব কর্মসূচির পাশাপাশি বছরব্যাপী কর্মসূচি প্রণয়ন করে ঈপ্সিত লক্ষ্যাভিমুখী অভিযাত্রার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
No comments