Adsterra

ফুটপাতের হকার থেকে মতিঝিলের ত্রাস নুরু, মাসে ৩০-৪০ লাখ চাঁদা তোলেন

ফুটপাতের হকার থেকে মতিঝিলের ত্রাস নুরু, মাসে ৩০-৪০ লাখ চাঁদা তোলেন, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Today Trending News, Today Viral News, Top News, Hot News

ছিলেন ফুটপাতের হকার। করতেন বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলের রাজনীতি। তবে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলেছেন নিজেকে। যোগ দিয়েছেন যুবলীগের রাজনীতিতে। এরপর ধীরে ধীরে ডালপালা মেলেছেন দেশের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিলে। ফুটপাতের দোকান থেকে বড় বড় অফিসসহ সর্বত্র রয়েছে তার চাঁদাবাজির বিস্তার। এ ছাড়া মাদক ব্যবসা, গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, মানি এক্সচেঞ্জ, পানি, বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এলাকায় নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে গড়ে তুলেছেন নুরু বাহিনী। তার নাম নুরুল ইসলাম চৌধুরী নুরু। মতিঝিল এলাকায় আতঙ্কের নাম। বিভিন্ন মামলার নথিপত্র এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। 


অভিযোগ আছে, স্থানীয় কাউন্সিলর মোজাম্মেল হকের ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম করছেন নুরু। চাঁদাবাজির টাকার বড় একটা অংশ পান কাউন্সিলর। আরও জানা গেছে, মতিঝিলে নুরুর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও রেস্তোরাঁ মালিকরা। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মতিঝিল এলাকা থেকে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার চাঁদা তোলেন নুরু। এ ছাড়া মতিঝিলের দিলকুশায় জমি দখল করে দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছেন, যা থেকে মাসে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা ভাড়া পান তিনি।


গত ৪ এপ্রিল রাতে মতিঝিলের এক ব্যবসায়ীর গোডাউন থেকে ৫০০ গ্যাস সিলিন্ডার চুরি করে নুরুর সন্ত্রাসী গ্রুপ। এ ছাড়া ক্যাশ থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়। এ বিষয়ে ১৩ এপ্রিল মতিঝিল থানায় নুরুসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন ভুক্তভোগী সিলিন্ডার ব্যবসায়ী পারুল বেগম। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০-১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।


মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল কালাম আজাদ কালবেলাকে বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডার চুরির অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক নম্বর আসামিসহ আরও এক আসামি জামিনে আছেন। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আমার জানামতে, তার (নুরু) নামে চাঁদাবাজিসহ আরও দুটি মামলা আছে।’


দিলকুশায় মেসার্স ফাতেমা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার অভিযোগে নুরুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে তিতাস কর্তৃপক্ষও।


ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক বই কিনুন রকমারি থেকে।   বই সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন

ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক বই কিনুন রকমারি থেকে। 

বই সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন 


ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৯ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৩২ নম্বর) যুবদলের সহসভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী নুরু। এমন কিছু কাগজপত্র এসেছে কালবেলার হাতে। এসব কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, যুবদলের কমিটিতে তার নাম আছে। মূলত এক যুবলীগ নেতার, যিনি ক্যাসিনোকাণ্ডে কিছুদিন কারাভোগ করেছেন, তার হাত ধরে নুরুর উত্থান।


ফুটপাতের দোকানে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে দোকানভেদে বাতিপ্রতি দিনে ৩০-৫০ টাকা নেন নুরু। এ ছাড়া ফুটপাতে দোকান বসাতে এককালীন তাকে দিতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। মতিঝিলের রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে শত শত দোকান বসিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন। দিলকুশায় অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ ছাড়াও ওয়াসার পানি ড্রামে করে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন। সিটি করপোরেশনের নামে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য চাঁদা নেয় নুরুর বাহিনী। ঘণ্টা মেপে গাড়িভেদে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুবদল থেকে যুবলীগের নেতা হওয়ার পর থেকে তার ভাই আহমেদ ইসলাম পুতুলের মাধ্যমে ইয়াবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন নুরু। চাঁদা তোলা ও মতিঝিল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১০ থেকে ১২ জনের একটি বাহিনী তৈরি করেছেন। এই বাহিনীর অন্যতম সদস্য তার ভাই আহমেদ ইসলাম পুতুলসহ মো. মনির হোসেন চৌধুরী, কাইলা সোহেল ও মোহাম্মদ ইসলাম। রাজউকের উত্তর পাশের গলিতে ‘দিলকুশা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে অফিস খুলেছে তারা। সব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয় এই অফিস থেকেই।


চাঁদাবাজি করে নুরু রাতারাতি বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন জায়গায় তার অঢেল সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে। মতিঝিলে দুটি দোকান, মুগদায় দুটি ফ্ল্যাট, মান্ডায় চার কাঠা জমি, নারায়ণগঞ্জে চার কাঠার ওপর একটি বাড়ি আছে তার। ফরিদপুর শহরে বাড়ি ও মার্কেটে একাধিক দোকান রয়েছে। রয়েছে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টও।


চাঁদাবাজি ছাড়াও নুরুর নামে বিভিন্ন থানায় চুরি ও হত্যার হুমকির মামলা রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ মোবারক হোসেন নামে এক ব্যক্তি চাঁদাবাজি ও হত্যার হুমকির অভিযোগে মতিঝিল থানায় সধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। একই থানায় একই অভিযোগে জিডি করেন মিজানুর রহমান নামে আরেক ব্যক্তি।


সম্প্রতি নুরুর অত্যাচার থেকে বাঁচতে নিরাপত্তা চেয়ে ডিবি কার‌্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মো. সিপন চৌধুরী। ডিবি কার‌্যালয়ে দেওয়া চিঠিতে সিপন লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ৩৮ দিলকুশায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পেছনে একটি বস্তি রয়েছে। সেখানে নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার ছোট ভাই আহমেদ ইসলাম পুতুল অবাধে মাদক ব্যবসা করেন। বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করায় ব্যক্তিগতভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাদক ব্যবসায় বাধা দিলে আমাকে এবং আমার পরিবারকে গুম ও প্রাণনাশের হুমকি দেন নুরু। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আমার রেস্টুরেন্টের অফিস রুমের সামনে এসে নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আহমেদ ইসলাম পুতুল, মোহাম্মদ ইসলাম, আ. জলিল, মো. মনির হোসেন চৌধুরী, কাইলা সোহেলসহ অন্তত ২০ জন এসে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।’


চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নুরুল ইসলাম চৌধুরী একটি হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ৩২ নম্বর ওয়ার্ড (মতিঝিল) যুবদলের সহসভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগের একজন হাইব্রিড নেতা হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাদকের কারবার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, ভূমি দখলদার হিসেবে পরিচিত। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’


মো. সিপন কালবেলাকে বলেন, ‘নুরুল ইসলাম চৌধুরী নুরু আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পেছনে মাদক ব্যবসা করেন। নিষেধ করায় আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। এজন্য জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে অভিযোগ দিয়েছি।’


নুরুর অপকর্মের বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘নুরুল ইসলাম চৌধুরী নুরু যুবলীগের কেউ নয়। একসময় যুবদল করত। পরবর্তী সময়ে সে যুবলীগের নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়। নুরুর অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু সে ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের কোনো পদপদবিতে নেই। এই নামে এই ওয়ার্ডে যুবলীগের কোনো নেতাকর্মীই নেই। নুরুর অপকর্মের বিষয়টি কেন্দ্রীয় যুবলীগসহ মহানগরের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।’


ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাফর আহমেদ রানা বলেন, ‘নুরুল ইসলাম চৌধুরী নুরুর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বে বেপরোয়া তিনি। এ বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগ, মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে নুরু যুবলীগের কেউ নন।’


ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাঈন উদ্দিন রানা বলেন, ‘মতিঝিল এলাকায় ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগে নুরুল ইসলাম চৌধুরী (নুরু) নামে আমাদের কোনো নেতা বা কর্মী নেই। দলের নাম ভাঙিয়ে সে যদি চাঁদাবাজি করে, প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হকের ছত্রছায়ায় নুরু এসব অপকর্ম করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মোজাম্মেল হক। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘নুরু আমার কাছে এলে কী করার আছে। আমি এটা জানি যে, দিলকুশা এলাকায় ফুটপাতের দোকান দেখভাল করে নুরু। আমি তাকে প্রশ্রয় দিই, এই অভিযোগটা বোধহয় ঠিক না।’

No comments

Powered by Blogger.