সোনাদিয়া প্যারাবনে দখলদারের থাবা, নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতা
মহেশখালী পৌরসভা থেকে পাকা সড়ক ধরে কুতুবজোম ইউনিয়নের দিকে ৮ কিলোমিটার গেলেই ঘটিভাঙ্গা খেয়াঘাট। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে সোনাদিয়া দ্বীপের দিকে এগোতেই চোখে পড়ে নয়নাভিরাম প্যারাবন। দুই পাশে সবুজ বন, মাঝখানে বয়ে গেছে খুব সুন্দর নদী। দেখতে অনেকটা সুন্দরবনের মতোই। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সোনাদিয়ার এই সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার ওপর ভর করে ‘সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক’ গড়ার পরিকল্পনা নেয় সরকার। কিন্তু যে বনকে ঘিরে এত পরিকল্পনা, সেটিই এখন ধ্বংসের মুখে।
চিংড়িঘের ও লবণের মাঠ তৈরির জন্য এরই মধ্যে প্রায় ৫ হাজার একর প্যারাবন কেটে উজাড় করে দিয়েছে প্রভাবশালীরা। বন উজাড়ে প্রকাশ্যে ও আড়ালে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম, বড় মহেশখালী ও পৌরসভা এলাকার ২৫-৩০ জন প্রভাবশালী।
গত শনিবার বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে প্যারাবন ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়েছে। দুপুর ১২টার পর তিন-চারটি ট্রলারে করে শতাধিক নারী-পুরুষকে সংরক্ষিত বন এলাকা থেকে ঘটিভাঙ্গায় ফিরতে দেখা যায়। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে ছিল দা, কুড়াল ও করাত। কথা বলে জানা যায়, নতুন ঘোনা (চিংড়িঘের) থেকেই ফিরছিলেন তাঁরা।
ওই শ্রমিকদের কয়েকজন জানান, প্যারাবন কেটে গত এক মাসে ২৫টি নতুন চিংড়িঘের ও লবণের মাঠ তৈরি করেছেন তাঁরা। একেকটি ঘেরের আয়তন ১৫০ থেকে ৩০০ একর। শুধু এই শ্রমিকেরা নন, তাঁদের মতো আরও অনেকেই প্রতিদিন প্রভাবশালীদের হয়ে দলে দলে গিয়ে প্যারাবন কাটার কাজ করছেন। প্যারাবনে ৩০টির মতো এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রশাসনের লোকজন অভিযানে গেলে তার আগেই খবর পৌঁছে যায় বনে। তখন প্যারাবনের ভেতর এসব এক্সকাভেটর লুকিয়ে রাখা হয়।
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক বই কিনুন রকমারি থেকে।
সোনাদিয়ায় প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘের ও লবণের মাঠ তৈরির প্রতিযোগিতায় খুনখারাবির ঘটনাও ঘটছে। গত ২ মার্চ দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে সাদ্দাম ও সাইফুল নামের দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
বন উজাড়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরা মহেশখালীতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি মহল আছে, যারা আড়ালে থেকেই প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের ও লবণের মাঠ করছে। অনেকেই আবার বিভিন্ন সমিতির নাম দিয়ে বনের জমি দখলে রাখছে। এ রকম দুটি সমিতির নাম ‘ঘটিভাঙ্গা পূর্বপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’ এবং ‘ঘটিভাঙ্গা পশ্চিমপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’। এই সমিতি দুটির নামে অন্তত ৩০০ একর প্যারাবন উজাড় করে চিংড়িঘেরে পরিণত করা হয়েছে।
বন উজাড়ে যাঁদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও আড়ালে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা হলেন মহেশখালী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল করিম, উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা মোস্তফা আনোয়ার চৌধুরী, মহসীন আনোয়ার চৌধুরী, কুতুবজোম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম, স্থানীয় ইউপি সদস্য ছিদ্দিকী রিমন, সাবেক মেম্বার নুরুল আমিন খোকা, আওয়ামী লীগ নেতা আমিরুজ্জামান আনজু, বিএনপি নেতা আলী আকবর, সোনাদিয়ার ছাবের আহমদ, সোলতান আহমদ, জাফর আলম, মোনাফ, ফারুক প্রমুখ।
উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল করিমের বিরুদ্ধে আগেও প্যারাবন উজাড়ের অভিযোগে মামলা আছে। তবে বন উজাড়ের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কোনো প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘের তৈরিতে আমি জড়িত নই।’
কুতুবজোম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলমও নিজের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘বন বিভাগের অধীনে থাকতে এভাবে বন উজাড় হয়নি। এখন কেন হচ্ছে, তা তদন্ত করা প্রয়োজন। বন উজাড়ে বাস্তবে কারা জড়িত, তা সবাই জানে।’
প্যারাবন দখলে নেতৃত্ব দেওয়াদের একজন উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন। যোগাযোগ করা হলে তিনিও অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঘটিভাঙ্গার মোহাম্মদ মালেক নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি ১০ বছরের জন্য জায়গা ইজারা নিয়েছেন।মালেকের কাছে জেলা প্রশাসনের ইজারার কাগজ আছে কি না—জানতে চাইলে জসিম বলেন, ‘১৯৯১ সালের আগে মালেক ইজারা পেয়েছিলেন।’
নির্বিকার বেজা, দায় নিচ্ছে না বন বিভাগ
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর সমুদ্র উপকূলে প্যারাবন সৃজন করেছিল উপকূলীয় বন বিভাগ। এসব প্যারাবন ও সোনাদিয়া দ্বীপের অনন্য সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে সরকার এখানে মালয়েশিয়ার আদলে ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গা এলাকায় বন বিভাগের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার একর জমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু জমি গ্রহণের সাত বছরেও বেজা কোনো স্থাপনা তৈরি করেনি, নেয়নি প্যারাবন রক্ষার কোনো উদ্যোগ। এদিকে বেজার হাতে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর বন বিভাগও সেদিকে আর নজর দিচ্ছে না। এই সুযোগটাই নিচ্ছে দখলদারেরা। এর মধ্যে তারা বনের কেওড়া, বাইন, নুইন্যা, হারগোজাসহ অন্তত ১০ প্রজাতির কয়েক লাখ গাছ ও লতাগুল্ম সাবাড় করে ফেলেছে।
জানতে চাইলে বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আয়ুব আলী বলেন, সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গা মৌজায় ১৪ হাজার একরের মতো প্যারাবন আছে। সেখান থেকে সাড়ে ৯ হাজার একর বন বেজার কাছে হস্তান্তর করা হয়। বেদখল হওয়া বেশির ভাগ বনই বেজার। তিনি আরও বলেন, ‘বেজাকে দেওয়ার আগে এই বন আমাদের দু-তিনজন স্টাফ দিয়েই পাহারা দিয়ে রক্ষা করা হয়েছে। এখন বেজা কেন পারছে না, তা তারাই ভালো বলতে পারবে।’
বেজার সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্কের দায়িত্বে আছেন সহকারী ব্যবস্থাপক হাবিব উল্লাহ। তিনি প্যারাবন উজাড়ের সত্যতা স্বীকার করে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্যারাবন উজাড়ের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। বন উজাড়ে কারা জড়িত, তার তথ্য সংগ্রহ চলছে। বন দেখভালের জন্য আমাদের ৫ জন স্টাফ আছে। এ মাসের মধ্যে বন রক্ষায় ১০-১৫ জন আনসার সদস্য নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।’
প্যারাবন উজাড় ঠেকাতে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করে স্থানীয় প্রশাসন। অভিযানের সময় দখলদারের লোকেরা পালিয়ে গেলেও পরে ঠিকই এসে একই কাজ করে তারা। জানতে চাইলে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীকি মারমা বলেন, ‘আমাদের সাধ্যমতো বন রক্ষায় চেষ্টা করছি। খবর পেলেই উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালাচ্ছে। প্যারাবন এতই দুর্গম যে সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে বেজাকে জানানো হয়েছে।’
উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা
দু-তিন দিন আগে সরেজমিন প্যারাবন উজাড়ের দৃশ্য দেখে এসেছেন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বিচারে প্যারাবন উজাড় অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে আমরা উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছি।’ কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন,‘সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গার সমৃদ্ধ প্যারাবন ও জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরির পরিকল্পনা কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্পের জমি থেকে কোন শক্তির ইশারায় বন উজাড় হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। না হলে অচিরেই প্যারাবনশূন্য হয়ে যাবে কক্সবাজার উপকূল।
No comments