মানুষ যে কারণে আশরাফুল মাখলুকাত
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টিজগতের মধ্যে মানুষকে সুমহান মর্যাদায় আসীন করেছেন। মানুষের এ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভের প্রধানতম কারণ বিশেষ গুণাবলি, যা অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে অনুপস্থিত। মানুষের অন্যতম গুণ হচ্ছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। এর মাধ্যমেই আল্লাহ আদম (আ.)-কে ফেরেশতাদের ওপর মর্যাদা ঘোষণা করেছেন এবং সেজদার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহর রাসুল (সা.) মানুষের মর্যাদার একটি কারণ বলেছেন কুরআন শেখা ও শেখানো। কারণ কুরআন মহান আল্লাহর সুমহান বাণী, দুনিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। শাশ^ত ও চিরন্তন মুজেজা। হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়’ (বুখারি : ৫০২৭)।
মানুষের অনন্য মর্যাদার আরও একটি গুণ হচ্ছে মানবিক ও সুন্দর ব্যবহার। এটা মানুষকে ঈমানের পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। উত্তম মুসলমানে পরিণত করে। কেয়ামতের দিন মিজানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী বস্তু হবে সচ্চরিত্র। মানবতাবোধ ও মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধনের ওপরই নির্ভরশীল এবং এটি মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। কোনো মানুষের চরিত্র গুণাবলি যখন সুন্দর হয়, তখন সে নিজে যেমন মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে, তদ্রূপ তার প্রতিবেশীর জন্য তা প্রশান্তির কারণ হয় এবং তার বেঁচে থাকাটা মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ হয়। উত্তম চরিত্র দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান ও মর্যাদায় কারণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (বুখারি : ৬০৩৫)
মানবজীবনের এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা হচ্ছে ঋণ আদান-প্রদান। এতে ঋণগ্রহীতা যেমন উপকৃত হয় তেমনি ঋণদাতাও এর মধ্য দিয়ে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাই প্রয়োজন পূরণের পর ঋণ পরিশোধে ইসলাম কঠোর গুরুত্বারোপ করেছে। কিছু মানুষ এমন আছে, যারা কোনোক্রমে ঋণ নিতে পারলে বেমালুম ভুলে যান। এতে সামাজিক ন্যায়নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস নষ্ট হয়। সমাজবদ্ধতা ও ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঋণ ব্যতীত শহিদের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’ (মুসলিম)। তাই ঋণ পরিশোধের বিষয়ে যে তৎপর হয়, নবীজি তাকে শ্রেষ্ঠ মানুষ আখ্যা দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে, যে ঋণ পরিশোধের বেলায় উত্তম।’ (বুখারি : ২৩০৫)
ঘরের বাইরে অনেক মানুষকে সাধারণত ভালো আচরণ করতে দেখা যায়। কিন্তু স্ত্রী-পরিবারের সঙ্গে তার উল্টো চিত্র দেখা যায়। এ কারণে নবীজি (সা.) উত্তম মানুষের মানদণ্ড বলে দিয়েছেন, ‘যে ব্যক্তি স্ত্রীর কাছে ভালো সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ। কারণ মানুষ নিজঘরে নিজেকে সবচেয়ে বেশি স্বাধীন মনে করে। তখন তার আসল চরিত্রটা ফুটে ওঠে।’ তাই উত্তম মানুষ হতে হলে ঘরে-বাইরে সর্বদাই উত্তম চরিত্রের চর্চা করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওই ব্যক্তি, যে তার পরিবার (স্ত্রীর) কাছে ভালো।’ (ইবনে হিব্বান : ৪১৭৭)
যারা মানুষকে সাহায্য করে, আল্লাহও তাদের সাহায্য করেন। হাদিস শরিফে এসেছে ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সংকটগুলো থেকে একটি সংকট মোচন করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার আখেরাতের সংকটগুলোর একটি সংকট মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-গুণ গোপন করবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে’ (মুসলিম)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী’ (সহিহুল জামে : ৩২৮৯)। আল্লাহর রাসুল (সা.) কথা ও কাজে সবসময় এক থাকা ঈমানদারের সাফল্য ও সম্মান। অন্তর যেন হয় সুন্দর আর কাজগুলো যেন হয় বিশুদ্ধ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ হলো সে-ই, যার অন্তর পরিচ্ছন্ন ও মুখ সত্যবাদী। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! সত্যবাদী মুখ বোঝা গেল কিন্তু পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী কে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বর্ণনা করেন, যে অন্তর স্বচ্ছ ও নির্মল, মুত্তাকি, যাতে কোনো পাপ নেই, বাড়াবাড়ি বা জুলুম নেই, নেই খেয়ানত ও বিদ্বেষ।’ (মাজাহ : ৪২১৬, সহিহুল জামে : ৩২৯১)
প্রতিবেশী মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। হাদিসে প্রতিবেশীর হকের প্রতি লক্ষ্য রাখাকে ঈমানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন প্রতিবেশীর হক রক্ষা করে। অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, আমাকে প্রতিবেশীর হকের প্রতি এত পরিমাণ তাগিদ দেওয়া হয়েছে যে, আমার মনে হতে লাগল, হয়তো কিছু দিন পর প্রতিবেশীকে মিরাস দেওয়ার ব্যাপারে বিধান নাজিল হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-‘আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে উত্তম। আর আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম প্রতিবেশী সে, যে তার প্রতিবেশীর কাছে উত্তম’ (তিরমিজি : ১৯৪৪)। এমন আরও কিছু বৈশিষ্টের কারণে মানুষকে নবীজি (সা.) শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর কোনোটিই একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। বরং সবই আপন আপন জায়গায় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় সবই শ্রেষ্ঠ। সর্বোপরি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে এসব গুণবিশিষ্ট শ্রেষ্ঠ মানুষের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক এই প্রত্যাশা।
No comments