সর্বাধিক স্বর্ণের মজুত যেসব দেশের, এত মজুতের উদ্দেশ্য কী
বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণের ব্যবহারের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। সতেরো শতক থেকে বিশ শতকের বেশির ভাগ সময় সরকারগুলো মজুতকৃত স্বর্ণের পরিমাণের ভিত্তিতে কাগজের নোট বাজারে ছাড়ত। এসব নোট সোনার আইনি মানদণ্ড বলে বিবেচিত হতো। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বর্ণই ব্যবহৃত হতো। ফলে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে দেশগুলো স্বর্ণের ভান্ডার গড়ত।
তবে বিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে বেশির ভাগ দেশ সোনা মজুতের ভিত্তিতে মুদ্রা তৈরি বন্ধ করে দেয়। ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ড মুদ্রার মান হিসেবে স্বর্ণকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়। তা সত্ত্বেও, হাইপার ইনফ্লেশন (অতি মূদ্রাস্ফীতি) বা অন্যান্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারগুলো এখনো স্বর্ণের মজুত রেখেছে।
এ ছাড়া ওষুধ, গয়না এবং ইলেকট্রনিক ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনাই সম্পদের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক বিনিয়োগকারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক এবং খুচরা উভয় ক্ষেত্রেই—সোনা হলো মুদ্রাস্ফীতি বা মন্দা মোকাবিলার প্রধান অস্ত্র।
তাই বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের স্বর্ণের মজুতের সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক বিদেশি সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মালিকানাধীন সোনার রক্ষকের ভূমিকা পালন করে।
স্বর্ণের সর্বাধিক মজুতকারী দেশ
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোনার মজুত রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এর পরের তিনটি বৃহত্তম স্বর্ণধারী দেশ—জার্মানি, ইতালি এবং ফ্রান্স। এই তিন দেশের মোট যে পরিমাণ সোনা মজুত আছে, সেই পরিমাণ স্বর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের একারই রয়েছে। শীর্ষ পাঁচের মধ্যে রয়েছে রাশিয়াও। এরপরেই রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির ২ হাজার ৮১৪ দশমিক ১০ টন (৩ হাজার ১০২ দশমিক ০১ স্ট্যান্ডার্ড টন) স্বর্ণ মজুত রয়েছে, যা জার্মানির মোট সোনার রিজার্ভের প্রায় সমান।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশগুলোর স্বর্ণের মজুতের বিস্তারিত বিবরণ:
ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক বই কিনুন রকমারি থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের মজুতে ৮ হাজার ১৩৩ দশমিক ৪৬ টন সোনা রয়েছে। ব্রেটন উডসে আন্তর্জাতিক বিনিময় ব্যবস্থা চুক্তির সময় যুক্তরাষ্ট্র ডলারের বিনিময়ে অন্যান্য দেশের সোনা সুরক্ষার প্রস্তাব দেয়। এরপর থেকেই সমগ্র বিশ্বের সোনার মজুতের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ আমেরিকার ভল্টে রয়েছে। কয়েক দশক পেরোলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনো সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মজুত ধরে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৭৫ শতাংশের বেশি স্বর্ণ।
জার্মানি
জার্মানির রিজার্ভে ৩ হাজার ৩৫২ দশমিক ৬৫ টন সোনা রয়েছে; যা দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দুই–তৃতীয়াংশ। দেশটির সরকার বিভিন্ন স্থানে স্বর্ণের মজুত রাখে। এসবের মধ্যে রয়েছে: ফ্রাঙ্কফুর্টে ডয়েচে বুন্দেসব্যাঙ্ক, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নিউইয়র্ক শাখা, লন্ডনের ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও প্যারিসে বাঙ্কে দ্য ফ্রান্স।
ইতালি
২ হাজার ৪৫১ দশমিক ৮৪ টন সোনা নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইতালি। ইউরোজোন সংকটের কারণে ইতালির সরকারের ওপর রিজার্ভ থেকে কিছু স্বর্ণ বিক্রি করার চাপ এসেছিল। তবে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
দেশটি সিংহভাগ সোনা (৮৭ শতাংশের বেশি) ব্যাংক অব ইতালির প্রধান কার্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে মজুত রেখেছে। বাকি অংশ সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের ভল্টের রয়েছে। ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, ঐতিহাসিক কারণে এবং ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন স্থানে স্বর্ণ সংরক্ষণ করে দেশটি।
ফ্রান্স
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সোনার মজুতকারী দেশ ফ্রান্স। দেশটির কাছে ২ হাজার ৪৩৬ দশমিক ৯৭ টন স্বর্ণ মজুত রয়েছে। ব্রেটন উডস ব্যবস্থার পতনের জন্য আংশিকভাবে দায়ী করা হয় ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গলকে। কারণ তিনি ফোর্ট নক্স রিজার্ভ থেকে সোনার বিনিময়ে ডলারের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জানতেন ৩৫ ডলারের বিনিময়ে সোনার এক আউন্স খুবই কম। এর ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণের মান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় এবং সোনার সঙ্গে ডলারের দূরত্ব তৈরি হয়।
রাশিয়ান ফেডারেশন
চীনকে পেছনে ফেলে ২০১৮ সালে ২ হাজার ৩৩২ দশমিক ৭৪ টন সোনার মজুত নিয়ে রাশিয়া বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম স্বর্ণের মজুতকারী দেশ হয়। দেশটি এর ধারাবাহিকতা এখনো ধরে রেখেছে। আমেরিকান বিনিয়োগ থেকে বেরিয়ে আসতেই রাশিয়া সোনার ভান্ডার বৃদ্ধি করে চলেছে। রাশিয়া মূলত স্বর্ণ কেনার জন্যই মার্কিন ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করেছে।
কেন দেশগুলো সোনার মজুত করে
বর্তমানে কাগজের মুদ্রার সঙ্গে স্বর্ণের কোনো সম্পর্ক নেই, এরপরও দেশগুলো এখনো সোনার মজুত রাখে কেন? এর কারণ হলো: যেকোনো সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকারগুলো নিজের জারি করা মুদ্রার বিনিময় মূল্য ধরে রাখতেই মূলত স্বর্ণ মজুত করে থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে সোনা রাখার কয়েকটি কারণ রয়েছে: স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীদের মতো সরকারকেও নিজের পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনতে হয়। বিনিয়োগের বিভিন্ন মাধ্যম রাখলে সরকারের ঝুঁকি কমে এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়।
যদিও স্বর্ণকেই মান বিবেচনা করা এখন অতীতকালের বিষয়; অনেক দেশের সরকার এখনো বিশ্বাস করে, স্বর্ণের মজুত মুদ্রায় কিছুটা স্থিতিশীলতা আনে।
সোনা একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এবং মুদ্রাস্ফীতি ঠেকায়। একটি দেশের অর্থনীতিতে আস্থা বাড়াতে সাহায্য করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারী ও গয়নার ক্রেতাদের মধ্যে সোনার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ২০২২ সালে ১৯৬৭ সালের মতো দ্রুত সোনা কিনেছে। আর বিশ্বে খনি থেকে উত্তোলিত স্বর্ণের এক–পঞ্চমাংশই ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।
১৯৬০–এর দশকে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর একটি সিন্ডিকেট স্বর্ণের নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এটি ছিল প্রতি আউন্স সোনার বিপরীতে ৩৫ ডলার। এই মূল্য নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৭ সালের দিকে বিনিয়োগকারীরা তখন সোনাকেই স্থিতিশীল ধরে নেন। তাঁরা বিপুল স্বর্ণ কিনতে শুরু করেন। প্রশ্নবিদ্ধ ব্যাংকগুলো এই সময় প্রায় ২ হাজার টন স্বর্ণ বিক্রি করে। এসব স্বর্ণের প্রধান ক্রেতাই ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।
No comments