তিন দেশে বেনজীরের সম্পদের খোঁজে দুদক
শুধু দেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সম্পদ রয়েছে–এমন খবরে বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশ তিনটিতে বেনজীরের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা জানতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে ওই সব দেশে তথ্য চেয়েছে সংস্থাটি। দুদকের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র আজকের পত্রিকাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, অনুসন্ধান শুরুর এক মাসের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় বেনজীর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়ার পর তিনি বিদেশেও অর্থ পাচার করেছেন বলে সন্দেহ করছে দুদক। এ কারণে দুবাই, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর কোনো সম্পদ থাকলে সেসবের নথিপত্র চেয়ে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে বিএফআইইউকে চিঠি দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেনজীর আহমেদের বিদেশে সম্পদের বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় তাঁর সম্পদ রয়েছে। সেসবের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব
এদিকে সম্পদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মির্জা ও তিন মেয়েকে তলব করেছে দুদক। গতকাল মঙ্গলবার সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে তাঁদের তলবি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। দুদক উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে আগামী ৬ জুন বেনজীর আহমেদকে এবং ৯ জুন তাঁর স্ত্রী জীশান মির্জাসহ সন্তানদের দুদকে হাজির হতে বলা হয়।
দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধানের শুরুতে বেনজীর পরিবারের বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে। এসব সম্পদের বিষয়ে ওই পরিবারের সদস্যদের আয়কর নথি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কীভাবে তাঁরা এসব সম্পদ গড়েছেন, তার ব্যাখ্যা দরকার। সে কারণে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন মনে করছে অনুসন্ধানী দল। আগামী ৬ জুন বেনজীর আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুসন্ধানী দলের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন অনুমোদন দিয়েছে।
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাঁকে (বেনজীর আহমেদ) বলতে হবে, এই সম্পত্তি কোত্থেকে এল, কীভাবে এল। দুদক সব সময় বৈধ সম্পত্তি দেখবে, সম্পত্তির উৎস দেখবে। তাঁর সম্পত্তি যদি অবৈধ হয়, তাহলে সেগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। সে জন্য সম্পদ ফ্রিজ (জব্দ) করা হচ্ছে। ফ্রিজ না করলে সম্পদ হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে।’
বেনজীর আহমেদের পরিবারের নামে থাকা ১৯৬টি দলিলে ৬২৭ বিঘা জমি (২০ হাজার ৭০৩ শতক) এরই মধ্যে জব্দ করা হয়েছে। এসব সম্পদের মধ্যে মাত্র ২৮ বিঘা নিজের নামে রেখে বাকি সম্পদ স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে করেছেন বেনজীর। স্ত্রী জীশান মীর্জার নামেই কিনেছেন ৫৪৩ বিঘা জমি। নিজের জেলা গোপালগঞ্জের তিন উপজেলা ছাড়াও মাদারীপুরের রাজৈরে এসব জমি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া পর্যটন জেলা কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন ও উখিয়ার ইনানী সমুদ্রসৈকতে বেনজীর আহমেদ নিজে, স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে জমি কিনেছেন।
এ ছাড়া বেনজীর পরিবারের কেনা রাজধানীর গুলশানে ৯ হাজার ১৯৩ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দ করা হয়েছে। এই পরিবারের নামে থাকা ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ২৫টি কোম্পানিতে শতভাগ ও আংশিক বিনিয়োগ করা অর্থ অবরুদ্ধ করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে এসব সম্পদ কিনেছেন বেনজীর আহমেদ। তিনি ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শুধু মাদারীপুরের রাজৈরে জীশান মীর্জার নামে প্রায় ২৭৩ বিঘা জমি কেনেন। এ ছাড়া অবসর নেওয়ার ৬ মাসের মধ্যে ২০২৩ সালের ৫ মার্চ এক দিনেই গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এগুলোর মধ্যে স্ত্রীর নামে তিনটি ও তাঁর নাবালিকা এক মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন।
অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, বেনজীর আহমেদের পরিবারের নামে দেশে-বিদেশে আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব এলাকায় তাঁর আরও সম্পদ থাকতে পারে, সেসব এলাকার সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সম্পদের নোটিশ জারি শিগগির
দুদকের চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বেনজীরের কাছ থেকে শিগগির সম্পদ বিবরণীর নোটিশ চাওয়া হবে বলে জানা গেছে। দুদকের অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিয়ে কমিশন বরাবর আবেদন করেছেন।
চাওয়া হবে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা
বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় তাঁদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালত বরাবর আবেদন করবে দুদক। সূত্র জানায়, চলতি সপ্তাহেই এ-সংক্রান্ত আবেদন আদালতে দাখিল করবেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাঁদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। তখন তিনি আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন।
No comments