Adsterra

ঢাকায় কাওয়ালির সূচনা

ঢাকায় কাওয়ালির সূচনা , ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Today Trending News, Today Viral News, Top News, Hot News


কাওয়ালির উত্পত্তি দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। সূচনা থেকেই কাওয়ালি মূলত দরগাভিত্তিক গাওয়া হতো। ধীরে ধীরে কাওয়ালির দল গড়ে উঠতে থাকে এবং তারা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দরগায় কাওয়ালি গাইতেন। নতুন নতুন দরগায় যাওয়ার কারণে কাওয়ালি পরিচিতি পাওয়ার পাশাপাশি জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং নতুন দল গড়ে ওঠে। এভাবেই এক সময় দিল্লি থেকে কত শত মাইল পার হয়ে কাওয়ালি এসেছিল ঢাকায়। হাকিম হাবিবুর রহমান জনশ্রুতি থেকে জানিয়েছেন, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য এবং কাওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমীর খুসরো নাকি অনেক দিন ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। যদিও এর ঐতিহাসিকতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া আরো একটি সূত্রের সন্ধান দিয়েছেন আনিস আহামেদ—‘সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতি ছিলেন সম্রাট আকবরের পীর সাহেব ফতেহপুর সিক্রি নিবাসী হযরত সেলিম চিশতির পুত্র। সে ঘরানার রেশ ধরেও ঢাকায় কাওয়ালি প্রথিত হওয়ার কথা। চিশতিয়া তরিকার প্রায় ৮০০ বছরের ধারাবাহিকতায় হিন্দুস্তানি ভাষাভাষী সমৃদ্ধ ঢাকায় সহস্রাধিক পীর-দরবেশের আগমন ঘটেছে। তাদের দরগা-খানকায় দিবারাত্রি কাওয়ালি চর্চার সুবাদে ঢাকাবাসীরাও কাওয়ালির ভালো সমঝদার হয়ে উঠেছিল।’ (ঢাকাইয়া আসলি)


ঢাকায় কাওয়ালির সূচনার সন কিংবা দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করা যায় না। তবে মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসকদের প্রভাব বিস্তৃত হওয়ায় ঢাকায় ইসলামী সংস্কৃতি বিকশিত হতে থাকে। পীর, ফকির, দরবেশদের তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ইসলাম প্রচারে তারাও ভ্রমণ করতেন ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এভাবে বাংলায়ও তাদের দরগা, খানকাহ ও মাজার তৈরি হয়। ধারণা করা যায়, কাওয়ালির দল দরগা থেকে দরগা, মাজার থেকে মাজারে ঘোরার মাধ্যমে এক সময় বাংলায় আগমন করেছিল। এভাবে মধ্যযুগের কোনো এক অনির্দিষ্ট সময়ে বাংলায় কাওয়ালির সূচনা। বাংলার অন্যতম প্রধান নগর ঢাকাতেও মাজার, দরগা গড়ে ওঠে। এগুলোয় নিয়মিত কাওয়ালি গাওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে নবাব পরিবারের সূত্রে কাওয়ালির উপস্থিতির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। নবাব পরিবার ছিল কাওয়ালির শ্রোতা, সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক।


নিজামুদ্দিন আউলিয়া ছিলেন চিশতিয়া তরিকার সুফি। প্রথম পর্যায়ে চিশতিয়া সিলসিলার অনুসারীরা কাওয়ালি গাইতেন। ঢাকার বেশির ভাগ দরগা চিশতিয়া তরিকার অনুসারী সুফিদের। ফলে সেখানে কাওয়ালি গাওয়া হবে এমনটাই স্বাভাবিক। সে হিসেবে কয়েকশ বছর ধরেই ঢাকায় কাওয়ালির চর্চা। এসব দরগায় রজব মাসে কাওয়ালি গাওয়া হতো। ঢাকার নবাবরা এক সময় কাওয়ালি শুনে আগ্রহী হয়ে ঢাকার কাওয়ালদের (যারা কাওয়ালি পরিবেশন করেন তাদের কাওয়াল বলা হয়) পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কাওয়ালদের আমন্ত্রণ করতেন। নবাবদের প্রাসাদে কাওয়ালির আসর বসত। নবাব সলিমুল্লাহ ও নবাব হাবিবুল্লাহ উভয়েই কাওয়ালি পছন্দ করতেন। তাদের বাড়িতে ও আহসান মঞ্জিলের বাইরে ওয়াইজঘাটে কাওয়ালির আসর বসত। সে সময়ে নবাব পরিবারের পাশাপাশি ঢাকার অভিজাতরা উর্দু-ফার্সির সমঝদার হওয়ার কারণে কাওয়ালি ও কাওয়ালরা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ‘মেহমান’ কাওয়ালদের কেউ কেউ হয়তো ঢাকাতেই থেকে গিয়েছিলেন। তাদের উত্তরপুরুষেরা এখনো ঢাকায় কাওয়ালি পরিবেশন করে থাকেন।

ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক বই  আসুন সুস্থ থাকি, মানসিক স্বাস্থ্য    বই সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন

ডা. আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্যপরামর্শ বিষয়ক বই  আসুন সুস্থ থাকি, মানসিক স্বাস্থ্য

  বই সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন


এদের মধ্যে ‘নাদীম কাওয়াল’ নামে সবিশেষ পরিচিত, নাদীম এহতেশাম রেজা খাঁ বংশপরম্পরায় কাওয়ালি পরিবেশন করছেন। তার কাছ থেকে জানা যায় তাদের পূর্বপুরুষ মূলত হযরত আলী (রা.) স্মৃতিবিজড়িত ইরাকের নাজাফ থেকে উত্তর ভারতে আসেন। প্রায় ১০০ বছর আগে তার প্রপিতামহ বাংলায় আগমন করেন এবং প্রায় তিন পুরুষ ধরে তারা ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার পিতা এহতেশাম রেজা খাঁ, দাদা ক্বায়াম রেজা খাঁ ও পরদাদা আমীর রেজা খাঁ জীবনভর এ ঢাকা শহরে নানা স্থানে কাওয়ালি গেয়েছেন। কাওয়ালি গাওয়া এবং এর প্রচারও তাদের কাছে সাধনার মতো। তারা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করতে কাওয়ালি গাইতেন। পরিবেশনের পাশাপাশি তাদের প্রচুর অনুসারী এবং ছাত্র তৈরি হয়, যারা কেবল ঢাকা নয়, বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানেও কাওয়ালি পরিবেশন করতেন, এখনো করেন। এ পরিবারের বাইরে মাইজভাণ্ডারের আবু কাওয়াল ও তার পুত্র ইসলাম কাওয়ালও জনপ্রিয়। ঢাকার কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জে হারুণ কাওয়াল জনপ্রিয় এবং কাওয়ালিপ্রেমিদের কাছে স্বনামে পরিচিত।


কাওয়ালির ভাষা হিসেবে সবাই উর্দুকেই জানে, তবে ফার্সিতেও কাওয়ালি রচিত এবং গাওয়া হয়। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে উর্দু চর্চা কমে গেলেও নির্দিষ্ট ঘরানার মানুষের মধ্যে কাওয়ালির চর্চা অব্যাহত। ঢাকার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখা পুরান ঢাকা কাওয়ালিরও তীর্থস্থান। সাধারণত ‘ওরশ’কে কেন্দ্র করে কাওয়ালি আয়োজিত হয়। এ ওরশ হতে পারে কোনো পীর কিংবা দরবেশের প্রয়াণ দিবস। এছাড়া বিয়ে এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও কাওয়ালি আয়োজিত হয়, তবে তা সীমিত পরিসরে। পুরান ঢাকার আবুল হাসনাত রোডের শিবলী মোহাম্মদ ফজলুল করিমের বাড়িতে কাওয়ালি আয়োজন হতো। ১৯৬৫-৬৯ পর্যন্ত আইয়ুব বেনারসী এবং প্রফেসর মোহাম্মদ হোসেন রাজ কাওয়ালির আসর বসাতেন। সবরী ব্রাদার্স নামে পরিচিত পাকিস্তানের দুই বিখ্যাত কাওয়াল ভাই গোলাম সবরী ও মকবুল হোসেন সবরী পুরান ঢাকায় বহুবার আমন্ত্রিত হয়ে কাওয়ালি পরিবেশন করেছেন। প্রথম সার্ক সম্মেলনের সময় তত্কালীন ওয়ার্ড কমিশনার গোলাম মোরশেদের আমন্ত্রণে তারা শিবলী মোহাম্মদ ফজলুল করিমের বাড়িতে এবং হোসেনী দালানের সুষমা মঞ্চে কাওয়ালি পরিবেশন করেন।


কয়েক দশক ধরে মূলত ঢাকার কাওয়ালির দুটো ধারা তৈরি হয়েছে—খাঁটি উর্দু কাওয়ালি ও উর্দু-বাংলা মিশ্রিত কাওয়ালি। এহতেশাম রেজা খাঁর মতো কাওয়ালরা প্রধানত উর্দু কাওয়ালি পরিবেশন করেন। বিভিন্ন ওরশে আয়োজিত যেসব কাওয়ালিতে ভারত, পাকিস্তানের শিল্পীদের আমন্ত্রণ করা হয়, সেখানেও উর্দু কাওয়ালি পরিবেশিত হয়। এর বাইরে বাংলা ভাষায়ও কাওয়ালি তৈরি হয়েছে। তবে এটা বলতে হয়, ঢাকায় কাওয়ালি নির্দিষ্ট শ্রোতাদের মধ্যেই সীমিত।


ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের মাক্কু শাহ মাজারে নিয়মিত কাওয়ালি আয়োজিত হয়। তিন-চার দিনব্যাপী সেখানে ‘মাহফিল-এ-সামা’ চলতে থাকে। গত বছরের নভেম্বরেও এখানে কাওয়ালি আয়োজিত হয়েছিল। এছাড়া হোসনী দালান, বড় কাটরায় আয়োজিত হয় কাওয়ালি। মগবাজারে শাহ সাহেব বাড়ি শাহান শাহ মাজারে জুলাই-আগস্টে কাওয়ালি আয়োজিত হয়। এখন পর্যন্ত কেবল উর্দু এবং বাংলা কাওয়ালির কথা বলা হলেও এর বাইরে ঢাকার শিয়া সম্প্রদায় নিজস্ব কাওয়ালি আয়োজন করে। এদের কাওয়ালির ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিয়াদের কাওয়ালির ভাষা বালুচ এবং কখনো কখনো পশতু। শিয়াদের কাওয়ালির আয়োজন বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। বিহারি ক্যাম্পে এখনো কাওয়ালি জনপ্রিয় এবং তারাও নিয়মিত কাওয়ালি আয়োজন করে।

No comments

Powered by Blogger.