Adsterra

দালাল চক্রের আখড়া মিটফোর্ড হাসপাতাল

দালাল চক্রের আখড়া মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Today Trending News, Today Viral News, Top News, Hot News


রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ চিকিৎসার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে এই হাসপাতালটিতে রোগীদের ব্যাপক সমাগম থাকলেও নেই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা। নির্দিষ্ট চিকিৎসক থাকলেও রোগীরা পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত চিকিৎসা। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো বহির্বিভাগে সঠিক সময় চিকিৎসকরা তাদের চেম্বারে থাকছেন না।


এছাড়াও দালালদের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন না অধিকাংশ চিকিৎসক। এতে করে হাসপাতালের দালালদের খপ্পরে পড়ে মিটফোর্ডের পাশেই থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।


সরেজমিনে বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুরান ঢাকার বাবুবাজারের মিটফোর্ড হাসপাতালে গেলে চোখে পড়ে নানা অনিয়ম ও রোগীদের ভোগান্তির দৃশ্য। হাসপাতালটিতে ঢুকতেই গেটের সামনে কাঁদতে দেখা যায় ৫০ বছর বয়সী এক নারীকে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, এই হাসপাতালে আসা রোগীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। প্রতিটি ঘাটে ঘাটেই পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। তার এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে শুরু হয় অনুসন্ধান।


সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই এই হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসেন কয়েকহাজার রোগী। এদের বেশিরভাগই আসেন জরুরি বিভাগে। সেখান থেকেই শুরু হয় অনিয়ম ও নানা দুর্নীতি। গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বা কোনো জরুরি রোগী ক্যাজুয়ালটি বিভাগে অস্ত্রোপচারের জন্য গেলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনো প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বর্তমানে হাসপাতালটির ক্যাজুয়ালটি বিভাগটি রোগীসেবায় শতভাগ কাজে আসছে না।


এখানে রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। হাসপাতালটিতে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি থাকলেও রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশেই থাকা ডায়গনিস্টিক সেন্টারগুলোতে। এতে করে হাসপাতালে আসা রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন রোগ নির্ণয় পরীক্ষা থেকে। আর মিটফোর্ড ঘেঁষা প্রাইভেট মেডিকেলে রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে গলা কাটা ফি।


দুপুর ১টার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের বহির্বিভাগের ইউরোলোজি বিভাগের ১০৮ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায় চিকিৎসক নেই। তবে বাইরে অনেক রোগী চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করে ফেরত যেতেও দেখা গেছে। এই কক্ষে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা ছিল আবাসিক সার্জন ডা. তাসলিম আরিফের।


এছাড়াও ২৩৫ নম্বর চেম্বারে পাওয়া যায়নি চিকিৎসক ফাতেমা ফারুককে। তিনি ডেন্টাল সার্জন। ২৩৩ নম্বর কক্ষের আরেক ডেন্টাল সার্জন মাহমুদুল হাসানকেও তার চেম্বারে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও মমতাজ বেগম মিতুও নেই তার চেম্বারে। অর্থাৎ ডেন্টাল বিভাগের এই তিনটি চেম্বার একেবারেই ফাঁকা দেখা গেছে। তবে সেখানে অনেক রোগীকেই ডাক্তারদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।


নাক, কান, গলা বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মো. খলিলুর রহমানকে দুপুর দেড়টায় গিয়ে তার চেম্বারে পাওয়া যায়নি। এমন দৃশ্য হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি বিভাগেই দেখা গেছে।


হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ ডাক্তাররাই ঠিক মতো চেম্বার করেন না। কিছু সময় চেম্বার করে ক্লাস করার নাম করে বের হয়ে যান। এতে করে অপেক্ষায় থাকা রোগীদের মিটফোর্ডের পাশে থাকা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে দালালরা নিয়ে যায়। আবার সেখানেই মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসকরাই মোটা অংকের ফি নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে।


এদিকে দপুর ১টা ১০মিনিটে মেডিকেলের বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারের সামনে কুকুর ঘুমানোর দৃশ্য দেখা গেছে। কাছে গিয়েই দেখা যায় টিকিট কাউন্টারগুলো বন্ধ। কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টিকিট বিক্রেতা ঢাকা টাইমসের এ প্রতিবেদককে বলেন, তারা দুপুর ১টার মধ্যেই টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেন। তবে মেডিকেলের ইমারজেন্সি ইউনিটের সামনেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক টাঙানো মিটফোর্ড হাসপাতালের সিটিজেন চার্টারে লেখা রয়েছে বহির্বিভাগে সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট সেবা দেওয়া হয়। সেখান থেকে নির্ধারিত ফি দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়।


রোগী ও রোগীদের স্বজনরা জানান, মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পেতে হলে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। হাসপাতালের অর্থোপেডিক, সার্জারি, পেডিয়াট্রিক সার্জারি ও প্লাস্টিক সার্জারি, ইএনটি, ইউরোলজি বিভাগে অস্ত্রপচারের জন্য রোগীদের ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অপারেশন থিয়েটার সংকটের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক চিকিৎসক।


হাসপাতালের সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। প্রতিটি ওয়ার্ড যেন মশা, তেলাপোকা, ছারপোকাসহ বিভিন্ন পোকামাকড়ের আবাসস্থল। টয়লেট ও মেঝেতে নোংরা পরিবেশে রোগীদের হচ্ছে ইনফেকশন। হাসপাতালের সিসিইউ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নোংরা মেঝেতে তেলাপোকা ও ছারপোকার বাসা। কোনো খাবার রাখতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে তেলাপোকার দল ঘিরে ধরছে।


এসব ওয়ার্ডের আয়া ও নার্সদের দাপটে কোনো রোগী কিংবা রোগীদের স্বজনরা কিছুই বলতে পারেন না। কারণ তারা অসহায় ভুক্তভোগী। প্রতিটি ওয়ার্ডে সেবিকার চেয়ে বেশি দালাল চক্রের সদস্যদের সংখ্যা। বিভিন্ন ওয়ার্ডের বারান্দা, করিডোরের পাশাপাশি প্রতিটি বিছানায় দুজন করে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। যদিও প্রকাশ্যে প্রতিনিয়ত আনসার সদস্যরা মিনি মাইকের মাধ্যমে বলে বেড়াচ্ছেন দালাল হতে সাবধান, কারো সঙ্গে কোনো আর্থিক লেনদেন করবেন না। তবে যেখানে আর্থিক লেনদেন ছাড়া কোনো সহায়তাই মেলে না, সেখানে কে শুনে কার কথা। বাইরে সতর্কতা থাকলেও ভিতরে সক্রিয় দালাল চক্র।


রুবেল নামে এক ব্যক্তি বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চেয়ে দালালরাই অনেক ভালো। কারণ তারা টাকা নিয়ে সঠিক রাস্তা দেখান। আর ডাক্তাররা তো সরকারি বেতন নিয়েও চিকিৎসা সেবা দেন না।


৯০০ শয্যাবিশিষ্ট স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দিন দিন স্বনামধন্য হাসপাতালটি নিজস্ব ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। অনেকেরই আস্থা উঠে যাচ্ছে এই হাসপাতালটি থেকে। মিটফোর্ডে রাতের বেলায় চিকিৎসক, নার্স, আয়া ও সুইপাররা দায়িত্বরত থাকলেও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে অনেক রোগী ও রোগীর স্বজনদের। তাদের অবহেলার কারণে হাসপাতালটির সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সেখানে থাকা খোদ কর্মচারীরাই।


অনুসন্ধানে দেখা যায়, মিটফোর্ডের পাশেই মেডিলাইফ ইস্পেশালাইজড হাসপাতাল, ফ্রীন হেলথ হাসপাতাল, ম্যাক্স লাইফ মেডিকেল সার্ভিস, ইন্টার্ন ডায়গনিস্টিক সেন্টার, মুন লাইট ক্লিনিক, আল আরাফাত হাসপাতাল, বাধন হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়গনিস্টিক সেন্টার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে মিটফোর্ড থেকে রোগী ভাগিয়ে দেয় দালাল চক্র। শুধু মিটফোর্ডে সেবা না পেয়েই অসহায় রোগীদের এভাবে প্রতিনিয়তই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।


মিটফোর্ডের পাশেই ম্যক্স লাইফ মেডিকেলে বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের জন্য মানুষের হিড়িক পড়তে দেখা গেছে। এ বিষয়ে সেখানে থাকা ময়না (২৬) নামে এক রোগী ঢাকা টাইমসকে জানান, তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে এসেছেন পেটের ব্যথা সারাতে। ইমারজেন্সিতে গেলে তাকে বলা হয় মিটফোর্ডের পাশেই থাকা মেডিকেল থেকে জরুরিভিত্তিতে বেশ কিছু পরীক্ষা করে তার রিপোর্ট নিয়ে আসতে। আর তার সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতালের এক নারী দালালকে। তাকে নিয়েই ময়না এই ক্লিনিকে এসেছেন পরীক্ষা করাতে।


পেটে ব্যথার জন্য ময়নাকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ-ছয়টি পরীক্ষা, সঙ্গে রয়েছে ডায়বেটিস পরীক্ষাও। আর পরীক্ষার ফি নেওয়া হয়েছে তিন হাজার টাকা। তবে খরচের অনেক রশিদই রেখে দেওয়া হয়েছে। কারণ এখানে কোনো রশিদ দেওয়া নিষেধ।


ম্যক্স লাইফ মেডিকেলের ভিতরে ও বাইরে রয়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালের কিছু চিকিৎসকের রোগী দেখার সময়সূচি। তারা রোগী দেখতে বসেন দুপুর ৩টা থেকে। যদিও সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত রোগী দেখার কথা মিটফোর্ড হাসপাতালে। সব মিলিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতাল এখন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দালাল চক্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.