মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে বাংলাদেশি কর্মীদের মানবেতর জীবন
গতকাল শুক্রবার (৩১ মে) থেকে বন্ধ হয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। যার কারণে গতকাল থেকে আর কোনো শ্রমিকই দেশটিতে প্রবেশ করতে পারছে না। শেষ দিন মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে দেখা যায় বিদেশি কর্মীদের জনস্রোত।
কুয়ালালামপুরের দুটি আন্তর্জাতিক বিমান টার্মিনালের ফ্লোরে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ১৪টি দেশ থেকে আসা প্রায় ২০ হাজার কর্মী অবস্থান করছিলেন। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি কর্মী বাংলাদেশের। বিমানবন্দরে কর্মীর উপচেপড়া ভিড়ের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় কর্মী ও নিয়োগকর্তাদের। নিজেদের কর্মী শনাক্তে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নিয়োগকর্তাদেরও।
এমন পরিস্থিতির মধ্যরাত ১০টার দিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হন। সেই সময় তিনি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন।
রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান পরে সাংবাদিকদের বলেন, ৩১ মে রাত ১২টার মধ্যে যারা নিজে নিজে দেশ থেকে ফ্লাই করবে এবং নিয়োগকর্তা এয়ারপোর্টে তথ্য দিয়ে রাখবে তাদের বিমান ১২টার পরে অবতরণ করলেও তাদের সবাইকে ঢুকতে কোনো বাধা থাকবে না। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টা নিশ্চিত করেছেন।
এই সময় রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, এ পর্যন্ত ৫ লাখ ২৭ হাজার কর্মীর ডিমান্ড সত্যায়ন করেছে বাংলাদেশ হাইকমিশন যার মধ্যে ৪ লাখ ৭২ হাজার এর বেশি কর্মী ইতোমধ্যে মালয়েশিয়াতে প্রবেশ করেছে। আজকে যারা বিমানবন্দরে আসছেন তাদের বিমান ১২টার অবতরণ পরে হলেও যাতে তারা সবাই ঢুকতে পারে সে ব্যাপারে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন। যেসব কর্মীদের ই-ভিসা ইস্যু করার পরেও যারা আসতে পারে নাই তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে আসতে পারে সেই ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
এদিকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র গড়ে দুর্নীতির অভিযোগে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর দুই দেশের মধ্যে অনেক দেনদরবার করে ২০২২ সালের আগস্টে আবার শ্রমবাজার খুলে দেওয়া হয়। সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত রাখার আন্দোলন হলেও তা করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। দেশে প্রথমে ২৫ এজেন্সি দায়িত্ব পেলেও পরে এটি বাড়িয়ে ১০০ এজেন্সি করা হয়।
দেশটিতে গিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী প্রতারিত হয়েছেন তার হিসাব একটু সরিয়ে রেখে অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতি অনুসন্ধান করে দেখা যায় এ যেন ফুটো কলসি।
তথ্য বলছে একজন কর্মী ৮০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা কাগজ কলমে থাকলেও সাড়ে চার লাখ থেকে ৫ লাখের বেশি ছাড়া কমে কেউ মালয়েশিয়াতে আসতে পারেনি। বিমান টিকিট বাদে একজন কর্মীর জন্য শুধু চক্র নিয়েছে দেড় লাখ টাকা। প্রতি কলিং বাবদ গড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা অবৈধ ভাবে দিতে হয়েছে। গত দেড় বছরেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য হয়েছে যার অধিকাংশ টাকা পাচার করেছে সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত এজেন্সিরা।
এদিকে এয়ারপোর্টে আসা কর্মীরা বলছেন, তারা তিন-চার দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন। কেউ নিয়োগকর্তার খোঁজ পাচ্ছে, আবার কেউ পাচ্ছেন না। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে কর্মীর উপচে পড়া ভিড়ের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় কর্মী ও নিয়োগকর্তাদের।
কলিং ভিসা আসা কর্মীরা কালবেলাকে বলেন, ৫ লাখ টাকার বেশি টাকা খরচ করে এসেছি যা পুরোটাই কিস্তি আর সুদ নিয়ে। যে খরচ করে এসেছি সেই টাকা কবে তুলবো জানি না।
অভিযোগ উঠেছে, নিয়োগকারীরা শ্রমিকদের বিমানবন্দর থেকে ইমিগ্রেশন পার করে দিয়ে রেখে চলে গেছেন। এ কারণে অনেক শ্রমিক বিমান থেকে নামার পর সেখানেই আটকা পড়ে গেছেন। দেখা গেছে, কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালে শুয়ে-বসে আছেন শ্রমিকরা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান রাত ৪টা পর্যন্ত বিমান বন্দরে অবস্থান করে সবাইকে নিশ্চিত করেন যাতে বাংলাদেশ থেকে আসা সকল বাংলাদেশি কর্মী যেন মালয়েশিয়াতে ঢুকতে পারেন।
এই সময় রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান মালয়েশিয়াতে আসা কর্মীদের সাথে কথা বলেন সবার খোঁজখবর নেন। রাত ৪টা পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসানকে কুয়ালালামপুরে এয়ারপোর্টে অবস্থান করতে দেখে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রবাসী কর্মীরা বলেন, মালয়েশিয়াতে ঢুকেই শান্তি লাগছে কারণ এতো রাত পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রদূতকে কর্মীদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখবো সেটা আমরা কোনো দিন চিন্তাও করি নাই।
এই সময় রাষ্ট্রদূত শামীম আহসানের সঙ্গে শ্রম কাউন্সিলর শরিফুল ইসলাম , প্রথম সচিব প্রেস সুফি আব্দুল্লাহিল মারুফ উপস্থিত ছিলেন।
No comments