পদ্মমির - ২৫ || ইলমা বেহেরোজ
আপনি নিশ্চিত কিছু হবে না?' সে বিচলিত।
ডাক্তার আমিরকে আশ্বস্ত করল, কিছু হবে না। প্রথম যে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল, তিনিও ঘুমের ঔষধ দিতে চাননি। আমির চেনা ডাক্তার থেকে ঘুমের ঔষধ এনেছিল। গতকাল পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়াতে আবার ঘুমের ঔষধ দিতে হয়েছে। এরপর থেকেই সে দুশ্চিন্তায় আছে। এখন নিশ্চিত হলো। এমন পরিস্থিতি আর আসতে দিবে না, যাতে পদ্মজার সামান্য ক্ষতিরও ঝুঁকি নিতে হয়।
রাত নয়টায় মুজ্জা কলোনিতে ঢুকতেই জাদতের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। আমির কিছু ফলমূল দেয় তার হাতে।
জাদও সন্ধ্যার ঘটনা খুলে বলতে গিয়েও বলতে পারল না। আমিরই প্রশ্ন করল, 'কিছু হয়েছে?"
জাদও সন্ধ্যার ঘটনা পুরোপুরি খুলে বলার পূর্বেই, আংশিক শুনে আমির উলটো দিকে দৌড়াতে থাকে।
মুজ্জা কলোনির বেশ কয়েকজন শুকতারায় রয়ে গেছে। সন্ধ্যার ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তারা পদ্মজাকে একা রেখে যাচ্ছে না। এতো রাত হওয়ার পরও আমির না ফেরায়, পদ্মজা শুকতারা থেকে বেরিয়ে পড়ে। গেইটের সামনে আসতেই দেখতে পায় আমির উদ্ভান্তের মতো ছুটে আসছে।
পদ্মজার পরনে বোরকা, নিকাব। সে নিকাব তুলল।
আমির ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। ফিসফিস করে বলল, 'ঠিক আছো তুমি?' ভয়ানক চমকে উঠল পদ্মজা। বিজলির গতিতে এসে জড়িয়ে ধরেছে আমির! তার কণ্ঠ শুনে আনন্দে বুক ভরে গেল। গভীর আবেগ আর ভালোবাসায় আমিরকে
জড়িয়ে ধরে বলল, ঠিক আছি।'
আমিরের চোখে ভেসে উঠে, অপহরণকারীরা কীভাবে পদ্মজাকে বস্তায় ভরেছিল। দলিলে সই করে দেয়ার পরও ওরা এরকম একটা কাজ করল! রাগে-ক্ষোভে জ্বলে উঠে আমিরের বুকের ভেতরটা।
সে পদ্মজার কপালে চুমু খেয়ে বলল, 'কসম তোমার, দ্রুত
সব ঠিক করব। আমরা বাড়ি ফিরে যাব।'
রাতে খেতে বসলে পদ্মজা বলল, 'ভুবন সারাদিন বাসায় আসেনি। ওর কোনো খোঁজখবর পেলেন?"
'ও এরকমই। বেশিদিন কোথাও থাকে না। হুট করে যা মন চায় করে ফেলে। ও নাকি গ্রামে চলে গেছে।'
'সুরুজ ভাই বলেছে?"
'ছ। চিন্তা করো না। ও এরকমই।'
পদ্মজার মন খারাপ হয়। এতো আদর করল তাও ভুবন চলে গেল! আমির আড়চোখে পদ্মজাকে দেখে।
পদ্মজা ঘুমাবার পর সে ভুবনকে সরিয়ে দেয়ার জন্য নিচে নেমেছিল। কিন্তু রুমে গিয়ে দেখে এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য। সামনে লাশ নিয়ে ভুবন থরথর করে কাঁপছে।
শুকতারায় রাতে দুজন লোক ঢুকেছিল। একজন আগে, আরেকজন পরে। শেষে যে ঢুকেছিল তাকে ভুবন মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করে খুন করেছে। লোকটার হাতে অস্ত্র দেখে পূর্বস্মৃতি মনে পড়ে যায় ভুবনের। বোনের হত্যা চোখের পর্দায় ছুটতে থাকে। পদ্মজাকেও কেউ খুন করতে এসেছে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই সে এলোমেলো হয়ে পড়ে। ডিসওর্ডারের প্রভাব শুরু হয়। সামনে কুড়াল পেয়ে তা দিয়েই আঘাত করে বসে গুপ্তঘাতককে। আমির ভুবনের পাশে বসে, তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।
বাইরে তখন তারস্বরে ঝিঝি ডাকছিল। আমির ফিসফিসিয়ে বলে, 'ভয় পাস না, ভয় পাস না। কাউকে এ কথা বলব না, কেউ জানবে না।'
ভুবন একটি হত্যার বিনিময়ে নিজের জীবন রক্ষা করেছে। রাতেই পুলিশের ভয় দেখিয়ে, পুলিশ থেকে বাঁচানোর আশ্বাস দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভুবনকে। এই গল্প কখনো পদ্মজা জানতে পারবে না।
আমির পদ্মজাকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানায়, পুলিশ গুপ্তঘাতকের পরিচয় শনাক্ত করেছে। এবার ধরার পালা। তারপর তারা বাড়ি ফিরে যাবে। এ কথা গুনে, পদ্মজা ভীষণ খুপি হয়। গুপ্তঘাতককের পরিচয় জানার ইচ্ছে প্রকাশ করে। আমির আরেকটি গল্প বানায়। তা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে পদ্মজা।
বাতাসের ধাক্কায় হাট করে খুলে যায় জানালা। রফিক ধড়ফড় করে উঠে বসে। জানালা লাগাতে গিয়ে দেখে আকাশে দিশাহীন কালো মেঘের ওড়াউড়ি। আলগা আলগা দখিনা বাতাস। বিছানা থেকে অর্ধনগ্ন জুনি জড়ানো পলায়
শুধায়, 'উঠলে কেন?' রফিক বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ছুঁড়ে দিল কথা, 'রাতটা যে থেকেছি সেটাই তোমার কপাল।'
সকাল সকাল এরকম আচরণ পেয়ে জুনির মুখজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিষন্নতা। সে রফিকের তৃতীয় স্ত্রী। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, চোখের। মণি কালো, স্বাস্থ্যবতী। স্বাস্থ্য অত্যাধিক বেড়ে যাবার পর থেকে রফিকের সাথে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এ নিয়ে রফিক সবসময় খোঁটা দেয়, অসন্তুটি প্রকাশ করে।
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। রফিক অপেক্ষা করে। বাতাসের গতি কমতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ময়নার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পাঁচজন স্ত্রী আর তিনজন রক্ষিতা নিয়ে তার জীবন। এদের মান-অভিমান, ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে করতে কাহিল হয়ে ভেবেছিল, আর কখনো কোনো নায়ীক সংস্পর্শে যাবে না। কিন্তু পদ্মজাকে দেখার পর থেকে সব স্ত্রী-রক্ষিতার।
বিনিময়েও পদ্মজাকে অন্তত এক রাত কাছে পাবার বাসনা জেগেছে মনে। পদ্মজাকে নিয়ে নষ্ট সব চিত্র ঘুরে বেড়ায় মানসপটে। আমির চুক্তি বাতিল করার আগে লোকদের পাঠিয়েছিল পদ্মজাকে তুলে আনতে। কিন্তু আমির হুট করে গুটি পাল্টে দিল। যেহেতু আমির ইয়াকিশাফির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করেছে তাই এই মুহূর্তে নতুন পদক্ষেপ না নেয়াটাই উত্তম বলে মনে হচ্ছে রফিকের। কিছুদিন যাক, তারপর পদ্মজাকে যেভাবে হোক তুলে আনবে - মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রফিক। অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে একটা হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে সকালের নাস্তা সাড়ল সে। যখন পুনরায় গাড়িতে উঠে তখন আকাশের মেঘ নিংড়ে ঝরতে শুরু করেছে ধরনীতে। এদিকের রাস্তা ভাঙা। একপাশে নদী, অন্যপাশে এবড়োখেবড়ো বিস্তৃত ক্ষেত। রাস্তা খাড়া থেকে ঢালু হচ্ছে। গাড়ির গতি কমাতে ব্রেকে পায়ের চাপ দিল রফিক। কাজ করছে না রেক! আবার ব্রেকে চাপ দিল। গাড়ির গতি বাড়ছে! বুক কেঁপে উঠল তার। সামনে তাকিয়ে দেখে একটা বাস আসছে। রফিকের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আগের চেয়ে জোরে ছুটছে গাড়ি, প্রতি মুহূর্তে গতি বাড়ছে। বার বার ব্রেক চাপল সে, কাজ হলো না। গাড়ির উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তার। কে ব্রেক নষ্ট করল? প্রথমে চোখের পর্দায় ভেসে উঠল আমিরের মুখ! বাসের ড্রাইভার দ্রুত গতিতে গাড়িটিকে এগোতে দেখে ভড়কে যায়। দ্রুত মোড় পরিবর্তন করে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। কিছু দূর এসে বাস থামিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। যাত্রীরাও সেদিকে তাকাল। তাদের চোখের সামনে রোলার কোস্টারের মতো ছুটতে থাকা গাড়িটি একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে নদীতে। ঝড়ো হাওয়া আর বজ্রপাতের বিকট শব্দে প্রত্যেকের বুকের ভেতর শুরু হয় কম্পন। তাই আর কেউ ওদিকে পা বাড়াল না। বাসটি নিজের গন্তব্যের দিকে ছুটতে শুরু করল।
ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বসে কিছু দলিলপত্র দেখছিলেন কুতুবউদ্দিন। সকাল থেকে তার তার মেজাজ বিগড়ে আছে। প্রথমে শুনলেন, বকুল বাড়িতে নেই। বাড়িতে পাঁচ জন কাজের মহিলা থাকা সত্ত্বেও বকুলকে রাখা হয়েছিল, তার ব্যক্তিগত সব কাজের জন্য। বকুলের হাতের চা কুতুবউদ্দিনের দিনকে সুন্দর করে। এতো ভালো চা যে কী করে বানায় এই মেয়ে ভেবে পান না তিনি। বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে গিয়ে দেখেছেন, বকুল কীভাবে চা তৈরি করে। অন্যরা যেভাবে বানায় সেভাবেই, অথচ স্বাদটা আলাদা হয়! তাই স্বাভাবিকভাবেই বকুলের হাতের চা না পেয়ে সকালটা মন্দ হয়ে উঠে। স্ত্রীর কাছে শুনেছেন, মাঝরাতে বকুলের বাবা উল্লাহ এসে মেয়েকে নিয়ে গেছেন। তার স্ত্রী নাকি খুব অসুস্থ। সারাক্ষণ, মেয়ে মেয়ে করছে। এদিকে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হবার কথা ছিল। আবহাওয়ার কারণে সেটা বাতিল করতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক হয়েছে। দিনটা বড় অলক্ষুণে! কিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছে না। টেলিফোন বাজছে। কুতুবউদ্দিন এতে বিরক্তবোধ করলেন। গজগজ করতে টেলিফোন কানে তুললেন, 'কে বলছেন?' ওপাশ একটা চেনা স্বর বলল, 'স্যার, আমি পারভেজ। আপনার ছেলে হামজাকে পাওয়া গেছে।' কুতুবউদ্দিন চমকে উঠলেন। হামজা পলাতক: অনেকের সন্দেহ কুতুবউদ্দিন হয়তো নিজের ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আদৌ তা সত্য নয়। হামজাকে পুলিশ গ্রেফতার করার পূর্বে কুতুবউদ্দিনের সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়। সেই অভিমান থেকে জেল থেকে পালানোর পরও বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কুতুবউদ্দিন চারিদিকে লোক লাগিয়েছেন, ছেলেকে খুঁজে বের করতে। খুঁজে পেলে দেশ থেকে নিরাপদে বের করে দিবেন। 51% তিনি চারপাশ দেখে ফিসফিসিয়ে বললেন, 'কোথায়... কোথায় আছে আমার ছেলে?' 'মুর্শিদি জঙ্গলের লোহার গম্বুজে।' এটা শুনে কুতুবউদ্দিনের পা থেকে মাথার তালু অবধি কেঁপে উঠল। এই লোহার গম্বুজকে ঘিরে রয়েছে এক গুপ্ত সৃস্মৃতি, তার প্রথম হত্যার স্মৃতি! তখন কুতুবউদ্দিনের বাইশ বছর, বেকার। তার বড় ভাই কাসেম ছিল দেশের একজন স্বনামধন্য মন্ত্রী। তার সামনে- পেছনে, ডানে-বামে ছিল শত্রুর মেলা। কুতুবউদ্দিন ক্ষমতার লোভে পড়ে বিপক্ষ দলের চক্রান্তে জড়িয়ে নিজের হাতে লোহার গম্বুজে পুড়িয়ে মেরেছিলেন কাসেমকে। তার হাতে হত্যার দায়িত্ব ছিল, কিন্তু কোথায় হত্যা করেছে তা কাউকে কখনো বলেননি। তাহলে হামজা কী করে ওই গম্বুজে গেল? ওপাশ থেকে পারভেজ বলল, 'হামজা রাতে এখান থেকে চলে যাবে। তার সঙ্গে আরো দুজন আছে।' কুতুবউদ্দিন কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। তিনি অবাক হয়ে ভাবছেন, হামজা কী কাকতালীয়ভাবে ওখানে পৌঁছাল? নাকি এর পিছনে অন্য কারণ আছে? ভেবে কোনো কূল কিনারা মিলল না। বুকে একটা সূচ ক্রমাগত আঘাত করছে যেন। কাসেম নিখোঁজের তদন্ত এখনো চলছে। কেউ যদি জেনে যায় তাহলে কী হবে? কুতুবউদ্দিন জানে, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। ওই গম্বুজে গেলেও কেউ প্রমাণ পাবে না। তবুও তিনি ভয় পাচ্ছেন। বিশ্বস্ত তিনজনকে নিয়ে কুতুবউদ্দিন রওনা হোন লোহার গম্বুজের উদ্দেশ্যো চলার পথ শেষ হচ্ছে না। আঁকাবাঁকা রাস্তা আর বৃষ্টির জন্য গাড়ির গতি বাড়ানোও সম্ভব নয়। কুতুবউদ্দিনের বুকে দুরুদুরু কাঁপুনি।
কেনো এই কাঁপুনি তিনি জানেন না। ছেলের জন্য মন ছুটে চলছে আবার কোথাও যেন মনে হচ্ছে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। তিনি দ্বিধান্বিত। গন্তব্য আর চলার মধ্যে কোথাও যেন একটা টানাপোড়েন চলছে তার মাঝে। সে টানাপোড়েন শেষ পর্যন্ত চলার গতিতে কোনো ব্যঘাত ঘটাতে পারেনি। জঙ্গলের গভীরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি থেমে যায়, সন্ধ্যে হয়ে আসে। বাকি পথ হেঁটে পৌঁছালেন লোহার গম্বুজের সামনে। চারপাশ দেখে নিলেন এক পলক। বাহিরে এক স্থানে পঁড়িতে শার্ট টানানো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে ছেলেটা বড্ড খামখেয়ালি! কতদিন ধরে আছে এখানে? জঙ্গল থেকে অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। চারপাশ বড় নির্জন। লোহার গম্বুজে কোনো জানালা নেই, একটামাত্র দরজা। তিনি একজনকে বাহিরে রেখে বাকি দুজনকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। নাকে এসে লাগে পেট্রোলের ঘ্রাণ। একটা অস্বস্তি হয় গায়ে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তিনি নরম সুরে ডাকলেন, 'হামজা... হামজা?' কোনো সাড়াশব্দ নেই। গম্বুজের ভেতর একটি ছোট ঘর আছে। কুতুবউদ্দিন গরটিতে ঢুকে দেখলেন একপাশে হারিকেন জ্বলছে। মৃদু আলোয় তারা একজনকে আবিষ্কার করল। দেয়ালের দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে আছে কেউ। কুতুবউদ্দিন টর্চ জ্বালিয়ে ডাকতে ডাকতে সেদিকে গেলেন, 'হামলা, কথা বলছিস না' কথাটি শেষ করার পূর্বেই চেয়ারে বসে থাকা মানুষটির মুখ দেখে চমকে উঠলেন তিনি। অস্ফুটম্বরে বললেন, পারভেজ।' গলা কেটে হত্যা করে চেয়ারে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকো তিন ঘন্টা আগেই না কথা হলো। ব্যাপারটা ধরতে ধরতে ঘরের বাহির থেকে তীব্র আলো ভেসে আসে। তিনি দৌড়ে ঘর থেকে বের হলেন। চারপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। গম্বুজ থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একটি দীর্ঘদেহী মানব ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। মানবটির মুখ এক পলক দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন কুতুবউদ্দিন। সেইসঙ্গে হঠাৎ করেই মনে পড়ল, এই লোহার গম্বুজ সম্পর্কে একজন জানত। সে হচ্ছে বাড়ির পুরনো দারোয়ান উল্লাহ! কিন্তু ততক্ষণে সময় ফুরিয়ে গেছে। যেভাবে ষড়যন্ত্র করে নিজের ভাইকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন ঠিক সেভাবেই তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। এই মৃত্যুর খবর কেউ জানবে না। হাজার চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারলেন না কুতুবউদ্দিন। তার করা বিকট চিৎকারে আঁতকে উঠে জঙ্গলের জীব ও কীটপতঙ্গরা।
পদ্মজা হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ জুড়ে অভিমান। আমিত্র এখনো বাড়ি ফিরেনি। বিকেলে অফিসের পিওন এসে বলে গিয়েছিল, 'স্যার বলেছেন, আজ ফিরতে দেরি হবে।' কেন ফিরতে দেরি হবে তা জানায়নি। পদ্মজা অভিমানী হয়ে ভাবছে, 'গতকাল আমার সঙ্গে ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে গেল তবুও আজ সারাদিন উনি বাইরে থাকলেন, রাতে ফিরতেও এতো দেরি করছেন। আমাকে নিয়ে কী চিন্তা নেই? অচেনা একটা এলাকায় একা ফেলে রাখতে পারল? আমার থেকে বেশি কাজটাই বড় হয়ে গেল?'
তার চোখে টলটল করে উঠল জল। আগে তবুও ভুবন ছিল। এখন সে একেবারে একা হয়ে গেছে। সারাদিন কত বৃষ্টি হলো, বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো পুরোটা সময় একা থাকতে হয়েছে। না, সে ভয় পায় না। কিন্তু একা একটা বাড়িতে থাকতে কী ভালো লাগে?
মনের ভেতর কত কথা ঘুরে বেড়ায়। একা থাকলেই পারিজার মৃত্যু আর হেমলতার মৃত্যু তাকে পোড়ায়। ভাইবোনদের খুব মনে পড়ে। পারিজার খুনিকে খুঁজে না পাওয়ার আক্ষেপে হৃদয়ে তোলপাড় বয়ে যায়।
পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজ আসুক... আসুক শুধু।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমিরকে দেখা গেল। সে বাড়ির ভেতর ঢুকছে। পদ্মজা স্যান্ডেল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমির আসতেই গুমোট মুখে স্যান্ডেল জোড়া এগিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আমির বাসায় ফিরেই প্রতিদিন গোসল করে অথবা গলা অবধি গা ভেজায়। ঠান্ডার দিন, এতো রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গা ধুলে সর্দি-জ্বর হবে। পদ্মজা গরম পানি বসাল।
আমির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে বলল, 'আজ খুব দেরি হয়ে গেল।'
পদ্মজা কিছু বলল না। সে রুম থেকে গামছা, ফতুয়া আর পায়জামা নিয়ে রেখে আসল গোসলখানায়। আমির পানি পান করতে করতে পদ্মজার ভাব-গতি দেখল। পদ্মজা যে আজ খুব ক্ষেপে আছে বোঝা যাচ্ছে!
কেন রেগে আছে বুঝতে পেরেও আমির নিষ্পাপ কন্ঠে বলল, 'কী? কিছু হয়েছে? মুখ গোমড়া কেন?'
সে শার্ট খুলে চেয়ারের উপর রাখল। পদ্মজা শার্ট নিয়ে বলল, 'কী হবে? কিছুই হয়নি।'
শার্ট ভেজা! পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল, 'ভিজেছেন কেন? বিকেলের পর ভিজলে আপনার ঠান্ডা লেগে যায় জানেন না? জ্বর হলে তো শুয়ে থাকবেন, সব জ্বালা আমার উপর দিয়ে যায়।' গজগজ করতে করতে সে শার্ট নিয়ে বারান্দায় চলে যায়।
আমির হাঁচি দেয়। অনেকক্ষণ ধরে হাঁচি দিচ্ছে। ইতিমধ্যে ঠান্ডা লেগে গেছে, মাথাটাও ব্যথা।
আমির চেয়ারে বসল। পদ্মজা উৎকণ্ঠা নিয়ে এসে তার কপালে হাত রেখে অনুভব করল, তীব্র উষ্ণতা! সে রীতিমতো ধমকে উঠল, 'কোথায় গিয়েছিলেন? ভিজেছেন কেন? জ্বর বাঁধিয়ে বসেছেন।'
'সন্ধ্যার দিকে বাড়িতেই ফিরছিলাম। ইমরানের বাবা মারা গেছে। জানাজায় গিয়েছিলাম।'
পদ্মজার চেহারা থেকে অভিমান সরে গিয়ে জায়গা নিল বিষণ্ণতা। বিড়বিড় করে বলল, 'ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। কীভাবে মারা গেল? অসুখে?'
'ক্যান্সার ছিল। কিছুক্ষণ আগে জানাজা হয়েছে।'
আমির গোসলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই পদ্মজা বাধা দিল, 'গোসল করতে হবে না, জ্বর বাড়বে। আমি গরম পানি দিয়ে গা মুছে দিচ্ছি।'
'জানাজা থেকে এসেছি। গোসল করতে হবে না?'
আমির রান্নাঘরে গিয়ে গরম পানির পাতিল ধরলে, পদ্মজা বলল, 'আমি নিয়ে দিচ্ছি।'
'গায়ে পড়বে। আমি নিচ্ছি।'
সে গরম পানি নিয়ে গোসলখানায় চলে যায়।
পদ্মজা দ্রুত হাতে টেবিলে খাবার সাজায়। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেয়। আমির গোসল সেড়ে টেবিলের পাশে দাঁড়াতেই পদ্মজা ঘুরে দাঁড়ায়। দুজন মুখোমুখি হয়।
আমির পদ্মজার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে বলল, 'আমার লক্ষ্য আর গন্তব্য দুটোই তুমি। যেখানেই যাই তোমার কাছেই ফিরে আসব।'
পদ্মজা ছোটার চেষ্টা করে বলল, 'বুঝেছি, ছাড়ুন।'
রান্নাঘরে শব্দ হতেই ওরা দুজন সেদিকে যায়। একটা বিড়াল। ঢুকেছে। আমির জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই পদ্মজা বলল, 'বৃষ্টিতে ভিজছিল। তাই ঘরে এনেছি।'
'আবার একেবারে রেখে দিও না যেন।'
'রেখে দিলে কী হবে?'
'কুকুর-বিড়াল আমার পছন্দ নয়। তবুও রাখবে?'
পদ্মজা কিছু বলল না। আমিরের পছন্দ নয় বলে ও কখনো কোনো পশু পালার কথা ভাবেনি। দুজন একসঙ্গে খেতে বসল।
আমির বলল, 'তুমি চাইলে আমরা আগামীকাল ফিরব।' পদ্ম নীড়ে
পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবল। বলল, 'আর দুইদিন থেকে যাই? বাড়িটার মায়ায় পড়ে গেছি।' আমির না করল না।
রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো তার। পদ্মজা সারারাত জেগে জলপট্টি দেয়, সেবা করে। শেষ রাতে আমির ফিসফিস করে বলল, 'যদি আমি আগে মারা যাই, আমার আত্মা থেকে যাবে। তোমাকে রেখে কোথাও যাবে না।'
জ্বরের ঘোরে মানুষ কত কী বলে! তবুও পদ্মজার বুকে কাঁপন ধরে যায়। তার আগে আমিরের মৃত্যু হবে সে ভাবতেই পারে না। বুকের ব্যথা তীব্র আকারে বেড়ে যায়। সে আমিরের উষ্ণ ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, 'আমার আগে
আপনি কোথাও যাবেন না।'
No comments