প্রতিবাদী প্রধান নির্বাচক থেকে বোর্ড প্রধান
বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখন চন্ডিকা হাথুরুসিংহের দাপট সবেমাত্র শুরু হয়েছে। তার অধীনে ২০১৫ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করে দেশে ফিরেছে দল। এতেই তিনি সাপের পাঁচ পা দেখে ফেললেন। তৎকালীন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের প্রশ্রয়ে হাথুরুসিংহে হয়ে উঠতে লাগলেন দেশের ক্রিকেটের হর্তাকর্তা বিধাতা। সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। তিনি যা চাইবেন তাই হবে! শুরুতেই তিনি হাত দিলেন নির্বাচক কমিটিতে। এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করে চলে গেলেন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। এরপর অনেক জল গড়াল পদ্মা-মেঘনায়। রাজনৈতিক পালাবদলে দেশ ছেড়ে পালালেন পাপন। তার জায়গায় ৮ বছর পর বিসিবি সভাপতি হয়ে দেশের ক্রিকেটে ফিরলেন সেই ফারুক আহমেদ।
১৯৬৬ সালের ২৪ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা ফারুক ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও নিয়েছেন। ১৯৮৮ সালের ২৯ অক্টোবর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ফরম্যাটের এশিয়া কাপ দিয়ে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়। একই ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল ওয়াহিদুল গণি ও আকরাম খানের। ওই সময় বাংলাদেশ এই একটি ফরম্যাটই খেলত। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ হতো কালেভদ্রে। বছরে দু-একটি ম্যাচ খেলায় ফারুক আহমেদরা নিজেদের প্রোফাইল ভারী করার সুযোগ পাননি। তবুও মাটি কামড়ে পড়ে থাকতেন ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকে। ৯ বছরের ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে মাত্র ৭টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলে ১০৫ রান করেছেন ফারুক। তার ক্যারিয়ারসেরা ৫৭ রান এসেছিল ১৯৯০ সালে চন্ডিগড়ে ভারতের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে তৃতীয় উইকেটে আতহার আলী খানের সঙ্গে তার ১০৮ রানের জুটি তুমুল আলোচিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন - বন্যায় স্বাস্থ্য সমস্যা : করনীয়
ফারুক ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ দল ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফি খেলেছিল। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ দিয়ে শেষ করেন ক্যারিয়ার। ২৭ মে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চেস্টার লিতে খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত ফারুক ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন ১৫ বছর। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৮ ইনিংসে ২৫৮ আর ২১টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে করেছেন ৪৩৭ রান। লিস্ট ‘এ’ তে ঢাকা মেট্রোর হয়ে তার অপরাজিত ১০২* রানের ইনিংস আছে।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে ক্রিকেটের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিলেন ফারুক। ২০০৩ সালে প্রথমবার জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক হয়েছিলেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত সেই মেয়াদে তিনি তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মতো ক্রিকেটারদের জাতীয় দলে নিয়ে আসেন; যারা পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন মহীরুহ। এরপর ২০১৩ সালে নাজমুল হাসান পাপনের আমলে তাকে দ্বিতীয় দফায় প্রধান নির্বাচক করা হয়। ২০১৫ বিশ্বকাপে নিজেদের ইতিহাসের সেরা পারফর্মেন্স করেছিল বাংলাদেশ দল। এরপর ঘরের মাঠে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জিতে দুনিয়াকে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয় টিম টাইগার। কিন্তু এই সুখ বেশিদিন সইল না। দলের সাফল্যের সুযোগ নিয়ে হাথুরুসিংহে হয়ে উঠলেন দেশের ক্রিকেটের ‘একনায়ক’! তার প্রেসক্রিপশনে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি গঠন করে প্রধান নির্বাচকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। হাথুরুর স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিসিবির সীমাহীন দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে ২০১৬ সালে পদত্যাগ করেন ফারুক আহমেদ।
বোর্ডের বাইরে চলে গেলেও মাঝেমধ্যে প্রদর্শনী ম্যাচে মিরপুরে দেখা যেত ফারুক আহমেদকে। একইসঙ্গে বোর্ডের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে তিনি সরব ছিলেন। গত তিন বছর ধরেই দলের পারফর্মেন্সের গ্রাফ নিচের দিকে যাচ্ছিল। মুখ ভরা বুলি ছাড়া পাপনের কাছে ছিল না কোনো সমাধান। অবশেষে এলো ৫ আগস্ট। বদলে গেল দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তীব্র ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান তার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত ইসমাইল হায়দার মল্লিকসহ বেশ কয়েকজন বোর্ড পরিচালক। রাষ্ট্র সংস্কারের জোয়ারে বিসিবি সংস্কারেরও দাবি ওঠে। অতঃপর গতকাল বুধবার নাজমুল হাসান পদত্যাগ করলে বিসিবি সভাপতির আসনে বসেন ৫৮ বছর বয়সী ফারুক আহমেদ।
কাকতালীয় ব্যাপার হলো, ফারুক আহমেদ যখন বিসিবি সভাপতি হলেন, তখন দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্বে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। দলের সঙ্গে পাকিস্তান সফরে থাকা শ্রীলঙ্কান এই কোচ ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই তার ভবিষ্যৎ দেখে ফেলেছেন। এদিকে দায়িত্ব গ্রহণের পর ফারুক নিজের লক্ষ্য নিয়ে বলেছেন, ‘লক্ষ্য অনেক বড়। প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য দেশের সম্মান বৃদ্ধি। দেশের মুখ উজ্জ্বল করা। দলকে একটা জায়গায় (ভালো) দেখতে চাই। কীভাবে দেখব সেটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। সুতরাং অনেক জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। অনেক দিন ধরে কাজ হয়েছে, হয় নাই, এসব নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমাদের প্রথম ও প্রধানতম দায়িত্ব হচ্ছে ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’
No comments