সংকট বাড়ছে নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরে
দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে অন্যতম নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর। এই জেলাগুলো থেকে এখনো সুসংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার বানভাসি মানুষেরা ত্রাণ পাচ্ছে না। টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালীর ৮ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে চাঁদপুরের নতুন নতুন এলাকা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান গতকাল সোমবার জানান, বন্যাকবলিত ১১ জেলার ৭৪টি উপজেলার মোট ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪ জন। মারা গেছে ২৩ জন।
আরও পড়ুন - বন্যায় স্বাস্থ্য সমস্যা : করনীয়
নোয়াখালীর বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরের রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩ থেকে ৬ ইঞ্চি পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পানিবন্দী অন্তত ৮ লাখ বাসিন্দা। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। রামগতি আবহাওয়া সতর্কীকরণ অফিসের কর্মকর্তা সৌরভ হোসেন বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৮০ মিলিমিটার। বন্যার অবনতি হচ্ছে। আরও কয়েক দিন বৃষ্টি থাকবে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
লক্ষ্মীপুরে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে ত্রাণ ও সুপেয় পানির সংকট। সদর উপজেলার লাহারকান্দি উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অসুস্থ হয়ে গতকাল ভোরে আবদুল মালেক নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন। কমলনগরে মাছ ধরতে গিয়ে খালে বন্যার পানির স্রোতে ডুবে মো. হৃদয় হোসেন (১৩) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে বন্যার অবনতির সঙ্গে ত্রাণসংকট বাড়ছে। বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তা অপ্রতুল। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেক এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ উজ জামান বলেন, রোববারের চেয়ে নিম্নাঞ্চলে কোথাও কোথাও ১০ সেমি পানি বেড়েছে। তিন দিন ধরে পানি অনেক বাড়ছে। বন্যার আরও অবনতি হচ্ছে।
আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বন্যার্তদের অনুদান দিতে ক্লিক করুন
কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি কিছুটা কমলেও উন্নতি হয়নি বন্যার পরিস্থিতি। প্রতিদিনেই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। বাড়ছে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা। ত্রাণের সমস্যা না থাকলেও হচ্ছে না সুষম বণ্টন। সুপেয় পানির অভাব, বস্ত্র, পানিবাহিত রোগসহ নানা সমস্যায় ঝুড়ি ভারী হচ্ছে প্রতিদিনই। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে বন্যাকবলিত হয়েছে ১৪টি উপজেলা। এতে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার ১০৯ জন। জেলার ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার মানুষ। বেসরকারি হিসাবমতে, পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা আরও বেশি বলে স্থানীয়ভাবে জানা যায়।
জেলার নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার বন্যায় আটকে পড়া গ্রামবাসীর মধ্যে পর্যাপ্ত ত্রাণ না পৌঁছানোর কারণে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে বানভাসি মানুষের মধ্যে। এসব এলাকার অধিকাংশ ইউনিয়নে এখনো কোনো ত্রাণ পৌঁছায়নি। মুছাপুর বাঁধ ভাঙার কারণে নাঙ্গলকোটের তিনটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। গতকাল স্রোতে পড়ে নাঙ্গলকোটের ঢালুয়া ইউনিয়নে আকতার আলী (২৬) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নাঙ্গলকোট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুরাইয়া আক্তার লাকি বলেন, ‘উপজেলাটির দুর্গম এলাকাগুলোতে পানি বৃদ্ধি ও যাতায়াতব্যবস্থা না থাকায় এখন পর্যন্ত কোনো খাবার পৌঁছায়নি। তবে আমরা স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
নোয়াখালীর ৮ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। গত শনিবার রাত থেকে একটানা মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি ও ফেনী থেকে নেমে আসা বন্যার পানিতে সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আরও কয়েকটি নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত এলাকাগুলোয় পানিবন্দী ও গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকাতে দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।
এদিকে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে নোয়াখালীর প্রধান ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলো। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফেনী থেকে নেমে আসা বন্যার পানি ও গত কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণের ফলে জেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। একই সঙ্গে ফেনী-চৌমুহনী, চৌমুহনী-মাইজদী, চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর, সোনাপুর-কবিরহাট ও সোনাপুর-কুমিল্লা সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠে গেছে।
সরকারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার তালিকায় রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এতে নেই চাঁদপুর। যদিও চাঁদপুরের শাহারাস্তি উপজেলায় উজানের পানি নেমে গত দুই দিনে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার। তানিয়া আক্তার নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘আমরাও শিশুদের নিয়ে গত দুই দিন এই আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। আমাদের বাড়িঘর সব পানিতে তলিয়ে গেছে; এখন কী অবস্থায় আছে, তা-ও জানি না।’
গতকাল সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত উপজেলার সুচিপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাড়িঘর পানির নিচে এবং রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। একইভাবে তলিয়ে গেছে মাছের ঘের এবং গবাদিপশুর ঘর।
কুমিল্লার বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে কচুয়া উপজেলার আশ্রাফপুর ইউনিয়নে। ইউনিয়নের পিপলকড়া, ভবানীপুর, সানন্দকড়া, রসুলপুরসহ বেশ কিছু গ্রামে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।
উন্নতি যেসব জেলায়
ফেনীতে অতি বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। অধিকাংশ এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জ, রাজনগর, কুলাউড়া ও সদর উপজেলা থেকে কমেছে বন্যার পানি। জেলার ৭৫ শতাংশ মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার অচল রয়েছে বলে সন্ধ্যায় জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও কসবায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে বন্যাদুর্গতরা। তবে বাড়ি ফিরে অনেকেই আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাচ্ছে না।
No comments