Adsterra

পদ্মমির - ২৬ ( অন্তিম) || ইলমা বেহেরোজ

পদ্মমির, ইলমা বেহেরোজ, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, bangla love story, romantic story, Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, romantic bangla poem, small bangla

সকালের দিকে আমিরের জ্বর কিছুটা কমে। বারান্দায় বসে সকালের চা পান করছিল আর পাখির ডাক শুনছিল। ভোরের সূর্যোদয় দেখেই পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকেছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সুরুজ বাজার-সদাই করে দিয়ে যায়। সেইসাথে বিনয়ের সঙ্গে বলে, 'ভুবনটা হঠাৎ চলে যাবে ভাবিনি। আপনাদের বিপদে ফেলল। তাই আমিই বাজার করে নিয়ে আসলাম। পদ্মজা সুরুজকে অপেক্ষা করে খেয়ে যেতে বলে। খাওয়ার লোভ হলেও আমিরের ভয়ে সে চলে যায়।

'চায়ের কাপটা নিয়ে যাও।' আমিরের গলা।

পদ্মজা কাপ নিতে যাবে তখনই দরজায় শব্দ হলো। এই সময়ে কে আসল? পদ্মজাকে থামিয়ে আমির এগিয়ে গেল।

দরজা খুলে আমির অবাক হয়ে যায়। মজিদ আর আলমগীর দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা মজিদকে দেখে দ্রুত মাথায় ঘোমটা টানল।

স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে মজিদের পা ছুঁয়ে সালাম করে।

পদ্মজা বলল,' কেমন আছেন আব্বা?'

মজিদ ভেতরে প্রবেশ করতে করতে গম্ভীর সুরে বললেন, 'ভালো। তাহলে এখানেই থাকছ তোমরা।'

আমির বলল, 'জি আব্বা।'

মজিদ আমিরকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, 'তোমাকে ওমন। লাগছে কেন? অসুস্থ? পদ্মজা, ওর কী হয়েছে?'

'জ্বর বাঁধিয়েছে আব্বা। বৃষ্টির মধ্যে গতকাল জানাজায় গিয়েছিলেন।'

'ডাক্তারের কাছে গিয়েছ? এখনের বৃষ্টি তো ভালো না। জ্বর সাড়ে না সহজে।'

আমির নম্র কণ্ঠে বলল, 'ফাক আব্বা। আপনি বসুন। পদ্মজা

রান্না বসাও। বাজার থেকে কিছু আনতে হবে?' 'না, না। সব আছে।'

মজিদ বাধা দিলেন, 'এতো তাড়াহুড়ো করো না। নাও মিষ্টিটা নাও। আমরা চলে যাব।'

পদ্মজা আঁতকে উঠল, 'সেকী! ছেলের কাছে এসেছেন, চলে যাবেন কেন?'

'ঢাকা আমার কাজ আছে। তোমাদের কথা শুনেছি, তাই দেখে গেলাম।'

'না, না আব্বা। এটা ঠিক না। এমন করছেন যেন পরের বাড়িতে এসেছেন। ছেলের বাড়িতে বাবা কখনো না খেয়ে যায়?'

'তোমরাই তো এখন বিপদে আছো।'

পদ্মজার জেদ, 'না আব্বা, আপনি থেকে যাবেন।'

'সেটা তো অসম্ভব। আমি কী-

পদ্মজা এগিয়ে আসল। অনুরোধ করে বলল, 'দয়া করে দুটো

দিন থেকে যানা আমার মা-বাবা কেউই তো নেই। কাকে এনে রাখব কাছে?'

মজিদ নিরুপায় হয়ে বললেন, 'এতো করে যখন বলছ, না থাকি কী করে?'

পদ্মজার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল, 'আম্মাকেও নিয়ে আসতেন। দুজন কিছুদিন আমার কাছে থাকতেন।'

'তোমার শ্বাশুড়ি এতো দূর আসার সাহস পায় না।'

মজিদ, আমির, রিদওয়ান গোল হয়ে ছাদে বসে আছে। রোদ নেই, বৃষ্টিও ষ্টিও নেই। চমৎকার পরিবেশ।

মজিদ বললেন, ইয়াকিশাফির চুক্তি বাতিল করা ঠিক হয়েছে?'

মজিদের আগমনে আমির বিরক্ত বোধ করছো তা তার চেহারায় ফুটে উঠেছে।

সে বলল, 'অকারণে কিছু করিনি।'

মজিদ বললেন, 'কারণটাই জানতে চাই।'


শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প। সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন

শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস "মানুষ" - ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প। সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন


তার কাজের জন্য তার কাছেই কৈফিয়ত! কিন্তু আমির রাগল না। সে যদি শহরের রাজা হয়, মজিদ গ্রামের রাজা। নারী সংগ্রহের ৮০ শতাংশ কাজ মজিদের নিয়ন্ত্রণে হয়। তিনি এতোটাই ক্ষমতাধর, চাইলেই অলন্দপুর থেকে বেরিয়ে পুরো নেত্রকোনা জেলার প্রধান হতে পারেন। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়াও তার ক্ষমতা নেত্রকোনার সর্বত্র জুড়ে। মজিদকে ছাড়া আমির কিছু না, আমিরকে ছাড়া মজিদ কিছু না। বাপ-বেঠা দুজন দুজনার পরিপূরক। একজনের ধ্বংস হলে রাজত্ব অর্ধেক খসে যাবে।

মজিদ আবার বললেন, 'আমি শুনেছি কুতুবউদ্দিন মারা গেছে। চুক্তি বাতিল না করে এই পরিকল্পনা করা যেত না? তুমি কীভাবে কী করেছ? কী ভেবে করেছ?"

আমির ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে পদ্মজার উপস্থিতি দেখল। বলল, 'তাহলে পুরো ঘটনা বলতে হবে। আমি চুক্তি বাতিল করার উদ্দেশ্যে কুতুবউদ্দিনের বাড়িতে যাইনি। গিয়েছিলাম দুটো কারণে। প্রথমত, বোঝার জন্য, কে কে আমার আর পদ্মজার সম্পর্কে জানে। কিন্তু ওখানে থাকা নেতাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে এরা কিছু জানে না। দ্বিতীয় কারণ, বাড়ির ভেতরে কে কে থাকে দেখতে চেয়েছিলাম। আমার বাড়িন ভেতরের খবর প্রয়োজন ছিল। হামজা কোথায় আছে জানা দরকার ছিল। বাকিটা ভাগ্যের জন্য হয়েছে। যখন ওরা আমাকে নিয়ে ভেতরে যায়, একটা মেয়েকে দেখি। মেয়েটার চেহারা উল্লাহর মতো। সন্দেহ হয়, ও হয়তো উল্লাহর মেয়ে। উল্লাহকে আমি চিনি। উল্লাহর মাধ্যমে চাইলেই মেয়েটাকে বের করে আনা যাবে। জানা যাবে, ভেতরকার কথা। রফিক আর ওর রক্ষিতা ময়নার দারোয়ানের কথাতে বুঝতে পারি, রফিক পরদিন কোথার যাবে। পরদিন সকালে ওর বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকি। যখন ও বের হয়, পিছু ধরি। পথে ব্রেক নষ্ট করে দেহা যদি ব্রেক নষ্ট না করতে পারতাম তাহলে ওর সাথে ময়নার বাড়িতেই যেতাম। ওখানেই ওকে খুন করতাম। কিন্তু পথেই ও মারা গেছে। আর কুতুবউদ্দিনের ঘটনা বোধহয় জানেন। এখন আমি যদি সেদিন ওই বাড়ি থেকে এমনি এমনি বেরিয়ে যেতাম, ওরা সর্বক্ষণ সতর্ক থাকত। চুক্তি বাতিল করেছি বলেই ওরা ভেবে নিয়েছে, আমি দূর্বল হয়ে গেছি, হেরে গেছি। এটা জয়ী হবার একটা গুটি ছিল মাত্র।'

'তাই বলে এতো বড় ত্যাগ! চাইলেই অন্য পরিকল্পনা করা যেত। বছর শেষে নির্বাচন কত টাকা প্রয়োজন। দলের লোকরাও এখন টাকা বেশি চায়। এটা একদম ঠিক হয়নি।' আমিরের পদক্ষেপে মজিদ অসন্তুষ্ট।

আমিরের তাতে যায় আসে না। পদ্মজা কিছু জানার আগে সব শেষ হয়েছে এতেই সে খুশি। কিন্তু কেন যেন সেই খুশিটা পরিস্ফুট হচ্ছে না! সে দায়সারাভাবে বলল, 'তিনটে অর্ডার আছে। দুটো চার মাসে দিতে হবে। আরেকটার জন্য পাঁচ মাস হাতে।'

'টাকা দিয়েছে?'

'অর্ধেক। নিয়ে যাবেন।'

আলমগীর মনে করিয়ে দিল, 'কুয়েতের নূরস হান্নানের ভাই। সব টাকা এডভান্স করেছে।'

'ওই টাকা আমার দরকার আছে। কক্সবাজারে বাংলো করব।

ওই টাকা আমার দরকার আছে। কক্সবাজারে বাংলো করব।' বলেই ও নিচে নেমে যাচ্ছিল, আলমগীর পিছন থেকে বলল, 'রফিক মারা যায়নি।' আমির চমকে পিছনে তাকায়।

  চোখ খুলেই প্রথমে ডাক্তারকে দেখতে পেল রফিক। নিজেকে আবিষ্কার করল একটি হাসপাতালের বিছানায়। ডাক্তার প্রশ্ন করল, 'দেখতে পাচ্ছেন রফিক সাহেব?' রফিক এক চোখে ঝাপসা দেখছে, অন্য চোখে অন্ধকার। তার মনে পড়ে গেল, দুর্ঘটনার কথা। এক চোখ কী নষ্ট হয়ে গেছে? ভেবেই আঁতকে উঠল সে, 'আমার ডান চোখে কী হয়েছে? কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?' 'আপনি একটি চোখ হারিয়েছেন।' রফিক হতবাক হয়ে গেল। কথাটি তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে বিছানা থেকে নামতে চাইল। শরীরে কী অসহ্য বেদনা। হাতে, পায়ে, মাথায় ব্যান্ডেজ। ডাক্তার বলল, 'আপনার শরীরের উপর দিয়ে প্রচন্ড ধকল গেছে। এখন কোথাও যাবার চেষ্টা করবেন না, বিশ্রাম নিন।' 'আমি কতক্ষন ধরে এখানে?" 'তিনদিন।' রফিক অবাক হলো। ডাক্তার বলল, 'আপনার স্ত্রী জুনি সারাক্ষণ আপনার সঙ্গে ছিলেন, সেবা করেছেন। আজ বাড়ি গেছেন।' 'আর কেউ ছিল না?' 'পুলিশ ইন্সপেক্টর হাকিম সাহেব বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছেন।' রফিক ভাবছে, 'কুতুবউদ্দিন কী আসেনি তাকে দেখতে?" জুনি ঢুকছে ঘরে। সে বলল, 'তিন দিন ধরে কুতুবউদ্দিন স্যার নিখোঁজ। পাওয়া যাচ্ছে না।' এমন ভয়ংকর কথা কখনো শুনেনি এমনভাবে তাকাল রফিক। জুনি বলল, 'হঠাৎ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তারপর আর খোঁজ মেলেনি।' রফিক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছো ভুনি রফিককে শুতে সাহায্য করল। রফিক ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে ভাবছে, কী হয়েছে তাদের সাথে? কুতুবউদ্দিন কী বেঁচে আছে? রফিক চোখ বুজল। অনেকক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইল। এই কাজ একমাত্র আমির করতে পারে। কিন্তু কীভাবে কী করেছে? কীভাবে পারল ও? বাসনকোসনের শব্দে চোখ মেলে চাইল সে। জুমি ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এসেছে। হেসে বলল, 'খেয়ে নাও।' খাবার দেখেই রফিক বুঝতে পারল সে কতটা ক্ষুধার্ত। গপগপ করে খেয়ে শেষ করে সব খাবার। জুনি বলে, 'আস্তে খাও, গলায় খাবার আটকাবে।' রফিক খেয়ে আবেগঘন গলায় বলল, 'তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।' 'কেন?' 'এইযে, তিনদিন তুমি আমার সেবা করলে।' জুনি রফিকের গালে হাত বুলিয়ে বলল, 'আমার বরের সেবা আমি করব না তো কে করবে?' রফিক খুশি হয়ে জুনির হাতে চুমু খায়। পরদিন সকালে রুমে এসে ঢুকে ইন্সপেক্টর হাকিম। তাকে দেখে রফিক উঠে বসল। 'কেমন আছেন?' হাস্যোজ্বল মুখে বলল হাকিম। রফিক হ্যান্ডশেক করে বলল, 'যে সবেমাত্র চোখ হারিয়েছে সে কী করে ভালো থাকবে?' 'ভাগ্যে যা ছিল হয়েছে। এটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ছিল। বাঁচবেন যে সেটা কেউ ভাবিনি। স্বয়ং আল্লাহ রক্ষা করেছেন।' 'এটা দুর্ঘটনা নয়, কেউ আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।' 'কেন এরকম মনে হচ্ছে?' 'আমি জানি।' 'সেরকম কোনো আলামত আমরা খুঁজে পাইনি।' 'দুর্ঘটনা নয় খুন। ওরা হয়তো আবার আমার উপর আক্রমণ করবে।' 'এটা শুধুমাত্র দূর্ঘটনা ছিল। আপনি ব্যালেন্স হারিয়েছিলেন।' প্রতিবাদ করে বলল হাকিম। রফিক আর কথা বাড়াল না। হাকিম সাহেব বলল, 'নিজের যত্ন নিন, আর চিন্তামুক্ত থাকুন। এখানে আপনি নিরাপদ।' রফিক মাথা ঝাঁকাল। হাকিম চলে যেতেই জুনি বলল, 'এটা সত্যি দূর্ঘটনা ছিল না?' রফিক কাতর স্বরে বলল, 'বিশ্বাস করো জুনি, আমি ব্যালেন্স হারাইনি। কেউ আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।' 'আমি বিশ্বাস করি। তোমার ক্ষতি করার জন্য গতকাল দুজন লোক এখানে ঢুকেছিল।' এ কথা শুনে রফিক ভড়কে যায়। চিৎকার করে উঠে, 'তুমি এ কথা পুলিশকে বলোনি কেন?" 'হাকিম সাহেব জানে। তবুও উনি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছেন।' রফিক বিড়বিড় করল, 'ওরা সব এক দলে...সব।' জুনি রফিকের মাথা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিল, 'আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।' রফিকের হঠাৎ মনে হয় জানালার পাশ থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই মানুষটা সরে যায়। রফিক ভয়ে ঢোক গিলল। জুনিকে ফিসফিসিয়ে বলল, 'আমরা রাতেই এখান থেকে চলে যাব। নয়তো ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।' 'তুমি এখনো সুস্থ হওনি।' রফিক জুনির হাত চেপে ধরে, অনুনয়ের চোখে তাকায়। ওর পাশে কেউ নেই। কুতুবউদ্দিন নিখোঁজ। হাসপাতালের পরিবেশ ঠিক লাগছে না। বাধ্য হয়ে জুনি রফিকের কথাতে সায় দিল। সেদিন রাতেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাউকে না জানিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায় রফিক। রাস্তায় একটা ট্যাক্সি দেখে উঠে পড়ে ওরা। রফিকের গিটে, গিটে ব্যথা। যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠছে কলিজা। জুনি বলল, 'আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজো। ততক্ষণে পৌঁছে যাব আমরা।' জুনির স্নেহার্দ্র আচরণে রফিক মুগ্ধা সে জুনির কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল। কখন ঘুমিয়ে পড়ল টেরই পেল না। চোখ খুলে পাশে জুনিকে দেখতে না পেয়ে রফিক জানালার বাইরে তাকাল। হাওড়ের মাঝে গাড়ি! রফিক চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। ড্রাইভার চুপচাপ বসে আছে। রফিক ঠোঁট ভিজিয়ে কোনোমতে বলল, 'জুনি...আ... আমার পাশে যে-' কথা শেষ করার পূর্বেই ড্রাইভার ঘুরে তাকাল। মানুষটিকে দেখে রফিকের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে যায়। রগে রগে পড়ে টান। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, 'তুই!' আমির দাঁত বের করে হাসল। গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় জুনি। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আলমগীর ও মজিদ হাওলাদার। রফিকের কাছে সবকিছু দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায়। জুনি প্রতারণা করেছে। ছলনা করে তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছে। পুলিশ আমিরের পক্ষে নয় বরং নিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। যা ভুল হবার হয়ে গেছো আমির হিসহিসিয়ে বলল, 'ভালোই হলো তখন মরিসনি। নিজের হাতে মেরে যে সুখ পাব, তা তখন মরে গেলে পেতাম না।'

রফিককে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ও ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে সেই হাওড়েই মাটিচাপা দিয়ে দেয়া হয়। চিরতরে গুন হয়ে যায় রফিক।

পদ্মনীড়ে প্রবেশ করতেই বেলি ফুলের ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। গতকাল তারা বাড়ি ফিরেছে। আমির কয়টা ফুল ছিড়ে শার্টের বুক পকেটে ভরে নিল।

কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলল পদ্মজা। আমির বুকপকেট থেকে ফুলগুলো এগিয়ে দিল পদ্মজার হাতে।

পদ্মজা ঘ্রাণ এঁকে বলল, 'আব্বাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছেন?'

'দিয়েছি।' আমির অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

পদ্মজা আমিরকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করল।

'আলমগীর ভাইও চলে গেছে।'

'ওমা! উনার না কিছুদিন থাকার কথা ছিল।'

আমির কিছু বলল না। আজ সে মিথ্যে বলতে চায় না। ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ঠেকতেই আমির পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'শুভ জন্মদিন পদ্মবতী। শত বছর বাঁচো আর আমার হয়ে থাকো। তোমার জন্মদিনেও আমি আমার জন্য তোমাকে চাই। কত স্বার্থপর আমি তাই না?'

পদ্মজার মনেই ছিল না আজ তার জন্মদিন। সে আমিরের বুক থেকে মুখ তুলে বলল, 'হ্যাঁ, ভীষণ। আর এমনই থাকবেন, স্বার্থপর। শুধু আমাকে চাইবেন।'

আমিরের দুই চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। কুতুবউদ্দিন, রফিক তাকে কত আতঙ্কে রেখেছে তবুও ভেঙে যায়নি। অথচ আজ যখন সব বিপদ শেষ তার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পদ্মজাকে হারিয়ে ফেললে কীভাবে বাঁচত সে?

পদ্মজার উৎকণ্ঠা, 'কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন?"

আমির হাসল। বলল, 'জানি না। কাপড়চোপড় ব্যাগে ভরে নাও। আলো ফুটতেই আমরা বেরিয়ে যাব।'

'আবার কোথায়?'

'স্বপ্নের জগতে।' আমির চোখ টিপল। বোট তৈরি। আগামী

দশদিন ওরা পদ্মা নদীতে কাটাবে।

পরিশিষ্টঃ

'মিষ্টি রানি দুই রাজাকে তার অপকর্মের জন্য হত্যা করেছিল। তাই রানির কারাবাস হয়। তারপর কী হয়? এই গল্পের বাকি অংশ কোথায় জানব আপা?' আলিয়া ঠোঁট উল্টে বলল।

নুড়ি আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বলল, 'মা জানে।'

'মা তো বলে না।'

'হয়তো গল্প শেষ, রানী এখনো কারাগারে আছে।'

'কিন্তু মা তো বলল, গল্প বাকি।'

নুড়ি বিরক্তি নিয়ে তাকাল। ওর বয়স ঘোল। মেদহীন, একহারা গড়ন। চোখজোড়া কালো, স্বপ্নময়। কালো রঙা কোঁকড়া চুল কোমর ছাপিয়েছে। ও বলল, 'তাহলে অপেক্ষা কর, মা নিশ্চয়ই একদিন বাকি গল্প বলবে।'

আলিয়া কার্থী মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। নুড়ি আনমনা হয়ে ভাবে, 'মা যতদিন না বলছে আমি তোদের কিছু বলতে পারব না, সেই দুষ্ট রাজা আমাদের বাবা আর মিষ্টি রানি আমাদের মা। আমি কেন সব জেনে গেলাম বলতো? মায়ের কষ্ট যে আমার সহ্য হয় না।'

আজ আমির হাওলাদারের মৃত্যুবার্ষিকী। এই রাতটা পদ্মজা একা একা পাহাড়ের চূড়ায় বসে কাটায়। তীব্র জ্বরের কারণে আজ যেতে পারেনি। সন্ধ্যা থেকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ কর্ণগোচরে এলো, দরজায় ঠকঠক শব্দ। এই নিশি রাতে কে ডাকে?

জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে পদ্মজা জানালার দ্বার খুলল। চাঁদের আলো লুটিয়ে গড়ে ওর গায়ে।একটা ভারী কন্ঠ বাতাসে ভেসে এলো, 'আজ কেন আসোনি?'

পদ্মজার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। দ্রুত চোখে চশমা পরে দেখল, জানালার পাশে আমির দাঁড়িয়ে আছে। ওর পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। মাথার উপর চাঁদ। যেন চাঁদটা তার সঙ্গী।

পদ্মজা আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, 'আপনি এসেছেন!'

'না এসে থাকি কী করে? তোমায় ছাড়া কখনো থেকেছি আমি?"

পদ্মজার ঠোঁট দুটি ভেঙে এলো, 'আমাকে ছাড়াই তো থাকেন।'

'আমি সবসময় তোমার সঙ্গে থাকি। কখনো ছেড়ে যাই না।'

'তাহলে সামনে কেন আসেন না? আমাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে? আপনি তো এমন ছিলেন না।'

'ক্ষমা করে দাও। আর লুকিয়ে থাকব না।'

'এবার কিন্তু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।'

নুড়ি পিছনে এসে দাঁড়ায়। পদ্মজাকে একা একা কথা বলতে দেখে ওর বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠে। জ্বর বাড়লেই পদ্মজার হ্যালুসিনেশন হয়। তখন একা একা বকবক করে, তার অদৃশ্য শ্রোতা হয় আমির হাওলাদার। নুড়িকে দেখে পদ্মজা হাসল, 'দেখ, তোর বাবা এসেছো আমাকে নিয়ে যাবে।  

পদ্মজার শরীর কাঁপছে। সে সম্পূর্ণভাবে জ্বরের নিয়ন্ত্রণে। নুড়ি পদ্মজার পায়ের কাছে বসে অনুনয় করে বলল, 'ও কথা বলো না মা, তুমি চলে গেলে আমাদের কী হবে? আমরা কোথায় যাব?'

পদ্মজা নুড়ির মাথায় হাত রেখে আমিরকে অনুরোধ করে বলল, 'আচ্ছা, কিছুদিন পরই যাব। আপনি কিন্তু আমাকে রেখে যাবেন না।'

নুড়ি বাইরে শুধু আকাশের চাঁদটাই দেখতে পাচ্ছে। সে পদ্মজাকে প্রশ্ন করল, 'বাবা দেখতে কেমন মা?'

পদ্মজা মোহগ্রস্তের মতো 'আমিরের দিকে তাকাল। আমির চোখ টিপতেই পদ্মজা হাসল, 'সুদর্শন। ঘন কালো চুল, অন্তর্ভেদী কালো চোখ, থুতনিতে কাঁটা দাগ, বলিষ্ঠ শরীর, ধবধবে সাদা দাঁত আর ভীষণ রসিক - -

সমাপ্ত।

No comments

Powered by Blogger.