তোমার অদম্য ইচ্ছাশক্তি তোমাকে সাফল্যের মঞ্চে তুলবেই
আমাদের সবার ভেতরে এক বিশাল শক্তি লুকিয়ে আছে। আর তার নাম হল ইচ্ছাশক্তি। যে শক্তি অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার। এই অফুরন্ত ইচ্ছাশক্তিকে যদি সত্যিকারার্থে জাগ্রত করা যায় তাহলে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে হলেও বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব। অদম্য ইচ্ছাশক্তি তোমাকে সফলতা আনতে সাহায্য করবে। অদম্য, অজেয়, পরিশ্রম করার ইচ্ছাশক্তি যার রয়েছে, বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তারই সবচেয়ে বেশি। সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছার জন্য প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করা। কিন্তু অনেক সময় আমরা আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করি না। নিজের ভেতরের ইচ্ছাশক্তিকে নিজের মাঝেই ঘুম পাড়িয়ে রাখি। নিজেকে ছোট মনে করি। মনে করি যে আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, আমাকে দিয়ে সম্ভব না। এমন ভয় আমাদেরকে আরো হতাশ করে রাখে। অথচ নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে যদি জাগিয়ে তোলা যায় তাহলে যেকোনো সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ বাক্য আছে - ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। সেই আদিকাল থেকেই এ প্রবাদ বাক্যটা মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। আমাদের অনেকেই এ বিষয়ে অসংখ্যবার ভাবসম্প্রসারণ লিখেছে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে এ বিষয়ে প্রতিনিয়তই পড়ান। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো ইচ্ছা নামক এই অফুরন্ত শক্তি আমাদের সবার মাঝে লুকিয়ে থাকলেও আমরা সেটার ব্যবহার করি না, ব্যবহার করতে জানি না, কিংবা ব্যবহার করার ইচ্ছেশক্তি নেই। ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করে কাজের সাফল্যে পৌঁছার চেষ্টা আমাদের অনেকের মাঝেই অনুপস্থিত। যদিও সঠিকভাবে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করা এবং সে ইচ্ছাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা সত্যিই কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই।
ইচ্ছা করলেই মানুষ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে। কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হয়েও সাফল্যকে ছিনিয়ে আনতে পারে। তার জন্য নিজেকে কখনো দুর্বল ভাবা যাবে না, নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে, ব্যর্থ হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। নিজের মাঝে যে বিশাল ইচ্ছাশক্তি লুকিয়ে আছে, এর ওপর অনেকেরই বিশ্বাস নেই। অনেকেই ভাবে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, এটি তার জন্য প্রযোজ্য নয়। যারা নিজের জন্য ইচ্ছাশক্তি প্রযোজ্য নয় বলে আলসেমি করে তারা মূলত তার ভেতর লুকিয়ে থাকা অফুরন্ত শক্তিটাকেই তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। অথচ ইচ্ছাশক্তিকে প্রবল করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লে সফল ভাবে ফলাফল বের করে নিয়ে আসা সম্ভব।
ইচ্ছাশক্তির জোরেই সব বাঁধার পাহাড় মাড়িয়ে অনেকেই সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে। আমাদের চারপাশেই এ রকম হাজারো উদাহরণ আছে। ২০১৪ সালে এইচএসসি’তে এক অন্ধ ছেলের গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার খবরে দেশব্যাপী আলোড়ন তৈরি হয়। প্রশ্ন উঠে জন্মান্ধ ছেলেটি কিভাবে এমন সাফল্য অর্জন করতে পারল। জানা গেল ছেলেটি চোখে না দেখলে কী হবে, তার মমতাময়ী মা তার বইয়ের পড়াগুলো মোবাইলে রেকর্ড করে রাখতেন, আর সে মোবাইলের রেকর্ড শুনে পড়া মুখস্থ করত। পরবর্তীতে সে এইচএসসি-২০১৪ পরীক্ষাতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল। এটি মূলত তার ইচ্ছাশক্তির কারণেই সম্ভব হয়েছিল। ইচ্ছাশক্তি প্রবল থাকলে শুধু চোখের প্রতিবন্ধকতা না, যেকোনো প্রতিবন্ধকতাকেই জয় করা সম্ভব। এমনই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার হযরতপুর গ্রামের কৃষক জাহিদ সরওয়ারের ছেলে জুবায়ের হোসাইন। মুখে কলম নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে সে। জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী জুবায়ের হাত-পা কাজে না লাগায় মুখেই কলম তুলে নেয়। খাতায় লেখালেখি শিখতে বছরখানেক সময় লাগলেও সে এখন স্বাভাবিক মানুষের মতো লিখতে পারে। জুবায়ের প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পেয়েছিলো জিপিএ ৪ দশমিক ২৫। জেএসসিতে সে জিপিএ ৫ পায়।
অনেক সময় আমরা ইচ্ছাশক্তির অভাবে নানান ধরনের হতাশা দুশ্চিন্তা ও মানসিক রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ি। যার ফলে কাজে চলে আসে অনীহা। কাজ করার সময়, বাঁধাবিপত্তির সময় ইচ্ছাশক্তিকে প্রবল রাখো, ইচ্ছাশক্তিকে স্থায়ী করার চেষ্টা করো। কারণ কাজের ইচ্ছা নির্ভর করে কাজের প্রতি আগ্রহের ওপর। কতটা আগ্রহের সাথে কাজ করছো তার ওপরই নির্ভর করে তোমার ইচ্ছা কতক্ষণ স্থায়ী হবে। ইচ্ছাশক্তি একটি পেশির ন্যায়, যা বেশি কাজ করার দরুন ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সে ক্লান্তিকে পূরণ করতে পরিমিত খাদ্য দরকার। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে দেহের অন্যান্য পেশির মত ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতাও বাড়ানো সম্ভব। ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই।
সুস্থ ও শারীরিকভাবে ভালো থাকার অন্যতম মন্ত্র হলো নিজের ইচ্ছে। হতাশা, দুশ্চিন্তা ও মানসিক রোগ থেকে মুক্তির অন্যতম মন্ত্র হলো নিজের প্রতি নিজের ইচ্ছে। (মানসিক বিভিন্ন রোগ ও তা থেকে প্রতিকার নিয়ে আমার “মানসিক স্বাস্থ্য” বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।) এর ফলে নিজের ভবিষ্যৎ, ক্যারিয়ার, স্মৃতিশক্তি ও দক্ষতা বাড়াতে মূলমন্ত্র শক্তি হিসেবে কাজ করবে। তুমি হয়ে উঠবে আগের থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ও সুস্থ। ইচ্ছাশক্তি প্রবল থাকলে যেকোনো প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা সম্ভব। আমরা যারা খারাপ রেজাল্ট করি, তারাও খুব হতাশায় ভুগে থাকি। এর কারণ ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী না করা। ছোট বড় সবাই কিছু না কিছু নিয়ে হতাশাতে ভুগছি। হতাশা এক ধরনের মানসিক রোগ। আর তুমি এই রোগে যদি আক্রান্ত হয়ে পড়ো, তাহলে তুমি সাফল্য অর্জনের লক্ষ্য থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাবে। সাফল্য অর্জন তো করতেই পারবে না, যা অর্জনে থাকবে তাও হারাবে। যার মধ্যে ইচ্ছাশক্তি থাকে হতাশা তাকে কখনও কাবু করতে পারে না।
ইচ্ছাশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ অধ্যবসায়ে হয়েছে মনোযোগী, যা মানুষকে তার সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। ইচ্ছাশক্তি মানুষের মনোবলকে দৃঢ় করে এবং কাজে সাফল্যের রসদ জোগায়। ইচ্ছা না থাকলে এক ধরনের জড়তা কাজ করে মানব-হৃদয়ে। ফলে কোনো আকাক্ষাও জাগে না। ইচ্ছাশক্তি প্রচন্ড শক্তিশালী হলে যেকোনো বাঁধা তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পৃথিবী জয় করার প্রবল ইচ্ছা থেকে নেপোলিয়ন ইউরোপ জয় করেছিলেন, আবরাহাম লিংকন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হতে পেরেছিলেন। স্বাধীন হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থেকেই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। তাই ইচ্ছাশক্তিই মানুষের কাজের ও সাফল্যের মূল শক্তি। ইচ্ছাহীন জীবন অর্থহীন। ইচ্ছা থেকেই প্রয়োজনের সৃষ্টি হয় আর প্রয়োজন থেকেই বের হয় সাফল্য পাওয়ার উপায়। তাই ইচ্ছাকে সাফল্যের মূলমন্ত্রও বলা হয়।
কেউ কেউ বলে থাকে, মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই যেহেতু সবকিছু হয়ে থাকে তাহলে ব্যর্থতার পেছনে ব্যক্তি-ইচ্ছা-অনিচ্ছার দায় কোথায়! এখানে সবচেয়ে বড় যে ভুলটা সাধারণত হয় তা হলো, আল্লাহর ইচ্ছাকে মানুষের ইচ্ছার মতো কিছু একটা বিবেচনা করা। বস্তুত আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের জন্য মূল শক্তি, যেই শক্তির বলে আমরা ইচ্ছা করতে পারি। আর আমরা তখনই কেবল ইচ্ছা করতে পারি যখন “আল্লাহর ইচ্ছা” আমাদেরকে ইচ্ছা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। এ ক্ষেত্রে একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মনে করো তুমি কোনো পাওয়ার স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ নিচ্ছো এবং সেই বিদ্যুৎ তুমি ইচ্ছামত বিভিন্ন কাজে লাগাচ্ছো। এখানে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য তুমি পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন তার ইচ্ছার অধীন। কিন্তু বিদ্যুৎ কোন খাতে ব্যবহার করবে সেটা তোমার ইচ্ছাধীন। বিদ্যুতের সঠিক কিংবা অপব্যবহারের দায় তোমার।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলেছেন - আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেন না। সে যা ভালো কাজ করেছে তার ফল পাবে এবং যা খারাপ করেছে তা তার বিরুদ্ধে যাবে। (সূরা আল বাকারা, আয়াত নং ২৮৬ ) হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী (সা) বলেছেন যে, আল্লাহ বেহেশতে ও দোজখে প্রত্যেক ব্যক্তির স্থান পূর্ব থেকেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। লোকেরা বললেন, হে, আল্লাহর রাসূল (সা)! আমরা কি আমল করা ছেড়ে দেবো এবং পূর্ব থেকেই লিপিবদ্ধ করে রাখা বিষয়ের ওপর ভরসা করে বসে থাকব? রাসূল (সা) বললেন, কেন থাকবে? যে ব্যক্তিকে যে স্থানের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তার জন্য সেই কাজ সহজ করে দেবেন। সৎ ব্যক্তির জন্য সৎকাজ করা সহজ হয়ে যাবে। বদ ব্যক্তির জন্য বদকাজ করা সহজ হয়ে যাবে। (বুখারি ও মুসলিম)।
No comments