Adsterra

‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ও একদিন শেষ হয়

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও একদিন শেষ হয়, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news, bangladesh news

ঢাকা ওয়াসায় তাকসিম এ খানের ১৫ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে তার সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করেছে সরকার। একই সঙ্গে ডিএমডি এ কে এম শহিদউদ্দিন এমডির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি এ পদে থাকবেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব দিকে কর্মকর্তারা পদত্যাগ করলেও তাকসিম ছিলেন অনড়। নিজের পদ রক্ষার শেষ চেষ্টা করেছেন আলোচিত সাবেক এমডি। এমনকি আত্মগোপনে থেকেও অফিস করেছেন।


ওয়াসার একটি সূত্র বলছে, বিএনপি ঘরানার কর্মকর্তা ও শ্রমিক দলের নেতাদের দিয়ে বিভিন্ন মহলে তদবির করে নিজের পদ রক্ষার জোর তদবির করেছেন তাকসিম। তিনি এমডি থাকা সময় এসব কর্মকর্তাকে নানা সুবিধা দিয়ে হাতে রেখেছিলেন। তারাও প্রতিদান হিসেবে তাকসিমকে রক্ষার জন্য নানা মহলে তদবির করেছেন। সব তদবির ব্যর্থ হলে বুধবার রাতে অনলাইনে পদত্যাগের খবর প্রচার করে তাকসিমের ঘনিষ্ঠ একটি মহল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তার কোনো পদত্যাগপত্র পাননি। পরে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সরকার ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ১৪/১০/২০২৩ তারিখে স্বাক্ষরিত ৩ বছর মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করছে। এ আদেশ ১৫ আগস্ট পূর্বাহ্ণ হতে কার্যকর হবে। ঢাকা ওয়াসা বোর্ড সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্র্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ৬ নং আইন)-এর বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের কার্যক্রম গ্রহণ করবে। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসায় কর্মরত জ্যেষ্ঠতম উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সব দায়িত্ব পালন করবেন।’


গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি : তাকসিম এ খানের সঙ্গে সরকারের চুক্তি বাতিলের খবর প্রকাশিত হলে নাগরিকদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই তাকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট করেছেন। বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির জন্য আন্দোলন করে আসা জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান কয়েকজনকে নিয়ে ওয়াসা ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে তিনি বলেন, ‘মানুষকে দূষিত পানি খাইয়ে অসুস্থ করেছে এই তাকসিম। তাকে সরিয়ে দেওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট নই। অবিলম্বে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে তার মতো কোনো অসভ্য এমডি ওয়াসায় না আসে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য পানির যে গুরুত্ব, তা তাকসিম অনুধাবন করতে পারেনি। দূষিত পানি দিয়ে বছরের পর বছর দাম বাড়িয়েছে। আমরা চাই পানির গুরুত্ব বুঝবে এমন একজন এমডি ওয়াসায় দেওয়া হোক। তার বিরুদ্ধে যে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত হোক।’


শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কাউকে পরোয়া করতেন না : তাকসিম এ খান সাবেক সরকারের প্রভাব বিস্তার করে ঢাকা ওয়াসায় একক রাজত্বে শাসন ও শোষণ করেছেন। তার অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও কোনো পরোয়া করতেন না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাকসিমের ‘সাত খুন মাফ’ হয়ে যেত বলে অভিযোগ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সেই ‘খুঁটির জোরে’ ঢাকা ওয়াসায় অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার রাজত্ব কায়েম করেন এ প্রকৌশলী।


চাকরি হারিয়েছেন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী : ঢাকা ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে কথা বললেই চাকরি খোয়াতে হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। গত ১৫ বছরে ছয় প্রকৌশলীসহ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। প্রকৌশলী রুহুল আমিন, রবিউল কাইজার, কাজী খায়রুল বাশার, অসীম কুমার ঘোষ, মোজাম্মেল হক এবং মহিউদ্দিন আরিফকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাছাড়া প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম, মোস্তফা কামাল, সালাম ব্যাপারী ও হুমায়ুনকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে।


রাজস্ব পরিদর্শক আতাউল করিম, জাকির হোসেন, সিদ্দিকুর রহমান, শামসুজ্জামান, পাইপলাইন পরিদর্শক শাহাবুদ্দিন সরকার, সহকারী পাইপলাইন পরিদর্শক মাহবুব আল রশিদ সরকার এবং পাম্প অপারেটর এমদাদুল হক জেমসসহ তার অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা আরও অনেককেই চাকরিচ্যুত করেছেন তাকসিম।


এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসায় তাকসিম সোনার খনির সন্ধান পেয়েছেন। এ কারণে তিনি যেকোনো মূল্যে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যুগ যুগ ধরে এ পদে আছেন এবং আরও থাকতে চেয়েছেন। ভয়াবহ দুর্নীতির কারণে তার গ্রেপ্তার এবং বিচার দাবি করছি।’


ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সম্পাদক শাহাবুদ্দিন সরকার বলেন, ‘ওয়াসাকে একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন তাকসিম। সে কর্মচারীদের সমবায় সমিতিতেও হস্তক্ষেপ করেছে। তার বিরুদ্ধে কথা বলায় শতাধিক কর্মচারী আজ চাকরি ছাড়া। আমরা তার বিচার চাই। তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা না হলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে।’


গ্রেপ্তার ছাড়াও কর্মচারীদের একগুচ্ছ দাবি : দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সব টাকা, যা বিদেশে পাচার করা হয়েছে, তা ফেরত আনা, ওয়াসায় তার দুর্নীতির সহযোগী প্রকৌশলী রফিক, আখতার, মহসিন, বদরুল, জয়নালসহ সবাইকে গ্রেপ্তার করা, তাকসিমের দুর্নীতিকে বাধা দিতে গিয়ে যারা তার আক্রোশের শিকার হয়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন অবিলম্বে তাদের পুনর্বহাল করা এবং ওয়াসায় সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, সেটআপবহির্ভূত নিয়োগ এবং আউটসোর্সিং নিয়োগ অবিলম্বে বাতিল করা।


দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেই বিদায় : গত বছর ১৭ মে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ওয়াসার এমডির স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় নিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন ওয়াসা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগের মূল বিষয় ছিল তাকসিম এ খানের লাগামহীন অনিয়ম দুর্নীতি। গোলাম মোস্তফা বলেন, তার (তাকসিম) অনিয়ম ও দুঃশাসনের তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা এখানে লেখা সম্ভব নয়। তাকসিম নিজের ইচ্ছেমতো ওয়াসা চালান এবং ঢাকা ওয়াসার অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই খারাপ। যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের তিনি বরখাস্ত করেছেন। অতীতে এরকম শত শত ঘটনা ঘটেছে। তাই চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। একটি সরকারি সংস্থা এভাবে চলতে পারে না।


তিনি বলেন, ওয়াসা আইন-১৯৯৬ অনুযায়ী প্রতি দুই মাস অন্তর বোর্ডসভা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এমডি প্রায়ই এ বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করেন। বোর্ড ও বোর্ডের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে ঢাকা ওয়াসা পরিচালিত হচ্ছে।


বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের বোর্ড চেয়ারম্যান যখন এমডির বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ করেন, তখন তা তদন্তের দাবি রাখে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে অভিযোগ করার চার দিন পর চেয়ারম্যানকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। এমডির অনুগত হিসেবে পরিচিত বোর্ড মেম্বার সুজিত কুমার বালাকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।


এমন ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সবাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-সহ বিভিন্ন সংগঠন এর নিন্দা জানায়। কিন্তু তাকসিমকে তার পদ থেকে সরানো তো দূরের কথা, তদন্ত কমিটিও গঠন করেনি মন্ত্রণালয়। এমনকি তৎকালীন চেয়ারম্যান একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ওয়াসার অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়।


ওয়াসা সূত্র বলছে, সাবেক এমডি তাকসিম এ খান ২০০৯ সালে যোগ দেওয়ার সময় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতন ছিল। ছয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে তিনি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন ও আনুষঙ্গিক সুবিধা নিয়েছেন। তিনি যোগ দেওয়ার সময় এ প্রতিষ্ঠানে বড় কোনো ঋণ ছিল না। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এজন্য বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোকে বুঝিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ওয়াসার কাঁধে ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা তুলে দিয়েছেন। একই সময়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের তদবিরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাঁচ শতাধিক গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছেন।


যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বাড়ি আছে এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে তাকসিম সংবাদ সম্মেলনে আসেন। তখন নিজেই দাবি করেন, তিনি, তার স্ত্রী, সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের বিষয়টি গোপন করে তাকসিম এমডি পদে নিয়োগ পেয়েছেন। তার প্রথম নিয়োগের সময় আমিই চেয়ারম্যান ছিলাম। কিন্তু তখন এটা জানলে তাকে নিয়োগ দিতাম না।’

No comments

Powered by Blogger.