আমি আর কবিতা লিখবো না।
আমি আর কবিতা লিখবো না।
আমি এখন ইতিহাস লিখব, একটা যুগের ইতিহাস ,একটা জাতির ইতিহাস।
ইতিহাসের প্রথম পাতায় আমি কিছুই না লিখে ,সেখানে এক জোড়া জুতো এনে রেখে দেব।
সেই জুতো ,
যে গুলো মানুষ চুরি হয়ে যাওয়া ভয়ে উপাসনা করার সময় উপাসনালয়ের ভিতরে নিয়ে রাখতে হয়।
পরবর্তী প্রজন্ম এগুলো দেখেই বুঝতে পারবে আমাদের চরিত্র কেমন ছিল।
আমি গ্রামের বাজারে গিয়ে দশজন গিরস্তের কাছ থেকে দশ ফোঁটা দুধ কিনে এনে রেখে দেব এখানে।
আমি জানি ,রহস্য উদঘাটনের জন্য মানুষ এগুলোকে রান্না করা শুরু করবে।
অনেকক্ষণ রান্না করার পরও যখন এখান থেকে মালাই হবে না, দই মাখন হবে না, মানুষ তখন বুঝতে পারবে আমাদের বেচাকেনার মান কেমন ছিল, ব্যবসায়ীক নৈতিকতা কেমন ছিল।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সুন্দর ও চাকচিক্যময় কিছু উপাসনালয়কে আমি রেখে দেব এর ভিতর।
ইতিহাস পাঠকরা যখন দেখবে উপাসনালয় গুলো সোনা রুপা মোড়ানো, আর উপাসনালয়ের সামনে বসে থাকা ভিক্ষুকদের কারো মুখে খাবার নেই ,কারো গায়ে পোশাক নেই।
পাটকরা তখন আমাদের ধর্মীয় জ্ঞান এবং গোড়ামী দুটো সম্বন্ধেই পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারবে।
আমি টাটকা নতুন কয়েকটা ১০০ টাকার নোট এনে ইতিহাস বইয়ের পাতার সাথে গেঁথে রেখে দেব।
এটা দেখে পাঠকরা প্রথমে কিছু বুঝতে পারবে না, ভালো করে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখার পর তারা লক্ষ্য করবে যে ,প্রতিটি টাকার এক কোনে পোড়া। তখন তারা বুঝতে পারবে এগুলো দিয়ে যুবকরা নেশা করত।
আমি হাসপাতাল থেকে ইচ্ছে করে ফেলে দেওয়া কিছু ভ্রুন, খাল, বিল, জঙ্গল থেকে ফেলে দেওয়া নবজাতকের কিছু রক্ত মাংস হাড় এনে রেখে দেব এখানে।
বইয়ের পাতা খুলতেই ওরা কান্না শুরু করে দেবে, ওরা চিৎকার করে বলবে আমরা নির্দোষ ছিলাম , আমাদেরকে অন্যায় ভাবে হত্যা করেছিল ওরা।
ওদের কথা শুনে জ্ঞানী মূর্খ সবাই আমাদের বর্বরতা সম্বন্ধে অনুমান করতে পারবে।
বন্দিসহ আস্ত একটা জেলখানা এনে আমি রেখে দেবো এর ভিতর।
মানুষেরা যখন দেখবে এর ভিতর কোন অপরাধী নেই,আছে শুধু রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার এবং ক্ষমতাসীনদের চক্রান্তে স্বীকার কিছু নিরপরাধ মানুষ।
তখন বুঝতে পারবে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থা কেমন ছিল।
কোন এক সুন্দরী বধুর সুন্দর হাতে লেখা একটা প্রেমের চিঠি এনে রেখে দেবো এখানে।
চিঠির ভাষায় মানুষ আবেগ আপ্লুত হয়ে যাবে, তবে চিঠির ঠিকানা দেখার পর সবাই হতভম্ব হয়ে যাবে।
মানুষ যখন দেখবে এ চিঠি বধু তার স্বামীকে লিখেনি ,লিখেছে তার গোপন প্রেমিককে, তখন তারা আমাদের পারিবারিক অবস্থার কথা ভালোভাবে বুঝতে পারবে।
একজন পিতা আরেকজন পুত্রকে এনে রেখে দেবো এখানে আমি।
মানুষ যখন দেখবে বৃদ্ধ পিতা বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে কাঁদছে, কিন্তু তার সম্পদশালী ছেলে তার কোন খোঁজ খবর নিচ্ছে না, তখন তারা আমাদের স্নেহপরায়ণতা ও দায়িত্বশীলতা সম্বন্ধে জানতে পারবে।
আমি বিশ্বকাপসহ বড় বড় কিছু প্রতিযোগিতার পুরস্কারের ট্রফি থেকে কিছু সোনা রুপা এনে রেখে দেবো এখানে।
ইতিহাস পাঠকরা যখন দেখবে দুনিয়া জুড়ে অসংখ্য মানুষ খাদ্য পানীয় এবং চিকিৎসার অভাবে ভুগছে, কিন্তু মানুষেরা এদিকে দৃষ্টিপাত না করে সবাই প্রতিযোগিতার ট্রফি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, পাঠকরা তখন আমাদের বুদ্ধি বিবেকের জীর্ণতা ও রুগ্নতা সম্বন্ধে ধারণা করতে পারবে।
শিক্ষাগুরুর যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করা কোন এক কিশোরীর ফাঁসির দড়িটা এনে রেখে দেবো আমি। সাথে তার লেখা চিরকুটটিও থাকবে।
ইতিহাস পাঠকরা চিরকুটটি পড়ে যা বোঝার তাই বুঝবে।
রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মা হয়ে যাওয়া পাগলিটাকেও আনবো আমি।
ইতিহাস পাঠক পাগলীর পেটে থাকা বাচ্চার বাবার সন্ধান না পেয়ে, বুঝতে পারবে সে যুগে নারীর ইজ্জত কতটা নিরাপদ ছিল।
সর্বশেষ পাতায় আমি আমার কলমটা রেখে দেবো।
মানুষেরা কলমটি হাতে নেওয়ার পর যখন এটার মধ্য থেকে কালি না পড়ে চোখের পানি পড়বে ,রক্ত পড়বে,তখন তারা বুঝতে পারবে সে যুগে সত্য কথা বলার কলম এবং কবি কোনটাই নিরাপদ ছিল না।
তিক্ত ইতিহাস
No comments